পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তার পরে বোধ হয় শ্বশুর-জামাই দু’জনকে দু’দিকে দাঁড়িয়ে আর সমস্ত গ্রামের হাসিতামাশা কুড়োতে হবে না। এই ত তোমার ব্যবসা, অতএব নিশ্চয়-প্রমাণ যে কাকে বলে সে আমাকে আর তোমাকে বলে দিতে হবে না।

 গৃহিণী পাথরের থালে মিষ্টান্ন ও বাটিতে দধি লইয়া প্রবেশ করিলেন, কহিলেন, কৈ বাবা খাচ্চো না যে?

 এই যে খাচ্চি, বলিয়া নির্মল আহারে মনোনিবেশ করিল।

 কর্তা কহিলেন, নির্মলকে দিয়ে, আমার জন্য একটু দুধ এনে দাও, শরীরটা ভালো নেই, দই আর খাবো না।

 গৃহিণী প্রস্থান করিলে রায়মহাশয় বলিলেন, অন্ধকার দুর্যোগের রাত্রে যে তোমাকে হাতে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল, তার জন্যে শুধু তুমি কেন বাবা, আমরা পর্যন্ত কৃতজ্ঞ; যে উপকার করে, তার অপকার করতে মন চায় না, কিন্তু এ ত আমাদের নিজেদের কথা নয় নির্মল, এ গ্রামের কথা, সমাজের কথা, দেব-দেবতার কথা, সুতরাং যা বড় কর্তব্য তা আমাকে করতেই হবে।

 সে রাত্রের ঘটনা যে অপ্রকাশ নাই তাহা সে শুনিয়াছিল, অথচ নিজে গোপন করিয়াছিল বলিয়া লজ্জিতমুখে চুপ করিয়া রইল।

 কর্তা বলিতে লাগিলেন, দেব-দেবীরা ত কথা কন না, কিন্তু তাঁরা শোধ নেন। গ্রামের ভালো যে কখনো হয়নি, উত্তরোত্তর অবনতি হয়েই আসছে, মনে হয় এও তার একটা কারণ। প্রমাণের কথা বলছিলে, কিন্তু তুমি যে আসচো এই বা আমরা জানলাম কি করে? তুমি সন্তানতুল্য, তোমার কাছে সব কথা খুলে বলতে আমার বাধে, কিন্তু না বললেও নয়। জমিদারবাবু, সে রাত্রে বোধ করি খেয়ে যাবার ফুরসত পাননি, ষোড়শী খাবার আনতে ঘরের বাইরে যেতে তাঁর চোখ পড়ল একটা চিঠির টুকরোর ’পরে। বোধ হয় তোমাকে লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে শেষে হৈমকেই লিখেছিল। সেখানাও আজ দেখতে পাবে, তিনি সকালবেলা আসবার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

 নির্মল ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, মিথ্যে কথা। সে নির্লজ্জ, নিজে অপরাধী, সেই মাতাল পাজী বদমাইসটার কথা আপনারা বিশ্বাস করেন? হতেই পারে না।

 রায়মহাশয় শুধু একটু মৃদু হাসিলেন। অবিচলিতস্বরে কহিলেন, হতে পারে, এবং হয়েছে। জমিদার লোকটা যে নির্লজ্জ, মাতাল, পাজী, বদমাইস তাও জানি। বোধ হয় আরও ঢের বেশী, নইলে তার কলঙ্কের কথাটা মুখে আনতেও পারত না। ওর নিষ্ঠুরতার অবধি নেই। গ্রামের মঙ্গলের জন্যও এ কাজে হাত দেয়নি, ঠাকুরদেবতা ও মানে না। জোর করে মন্দিরে খাসি বলি দিয়ে খেয়েছিল। আবশ্যক, হলে ও-পাষণ্ড মুরগী, শুয়োর, এমন কি গো-বধ করেও খেতে পারে।

 তবও তাঁকে আপনি সাহায্য করতে চান?

 না, আমি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাই।

 নির্মল অনেকক্ষণ স্থির থাকিয়া কহিল, আপনার কাঁটা উঠবে কিনা জানিনে, কিন্তু সে নিষ্কণ্টক হবে। দেবির যে সম্পত্তিটা সে বিক্রি করতে চায়, ষোড়শী ভৈরবী থাকতে

১২৪