পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তার সুবিধে হবে না।

 রায়মহাশয় কহিলেন, সে গেলেও সুবিধে হবে না―আমি আছি।

 তিনি আছেন এতবড় ঘটনাটা নির্মল বিস্মৃত হইয়াছিল, তাহার তৎক্ষণাৎ মনে হইল, জমিদারের সুবিধা না হইতে পারে, কিন্তু দেবীরও সুবিধা হইবে না। তবে সে সুবিধাটা যে কাহার হইবে তাহাও মুখ দিয়া বাহির করিল না।

 রায়মহাশয় স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, বাবা নির্মল, তুমি বড় আইনব্যবসায়ী, অনেক বোঝ, কিন্তু সংসারে এসে খালি হাতে আমাকে যখন লড়াই শুরু করতে হয়েছিল, তখন শুধু কেবল বিষয় সম্পত্তি জমা করেই কাটাই নি, মাথার ভেতরেও কিছু কিছু সঞ্চয় করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তোমাকে লোকে বলেচে ওই জমিটুকুর ওপরেই জমিদারের লোভ―ষোড়শী কড়া মেয়ে, ও থাকতে কিছু হবার নয়, তাই নিজেদের কলঙ্কটা রটিয়ে তাকে তাড়াতে চায়। আচ্ছা বাবাজী, বীজগাঁর জমিদারের কাছে ওটুকু কতটুকু সম্পত্তি? তার টাকার দরকার, একটা না হলে আর একটা বিক্রি করবে―আটকাবে না কিন্তু যেখানে তার সত্যিকার আটকেচে, সে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই জঙ্গলের মাঝে মাসের পর মাস সে আর পারে না, শহরের মানুষ শহরে যেতে চায়। নির্মল, হৈমর মত তুমিও আমার ছেলে, তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু ওই ছুঁড়িটার ভালই যদি করতে চাও ত বলে দিয়ো, তার ভয় নেই। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীগিরির মুনাফা বেশী নয়, যা তার যাবে, জমিদার তার চতুর্গুণ পুষিয়ে দেবে, এ আমি শপথ করে বলতে পারি। সে তাকে কষ্ট দিতেও চায় না―কষ্ট দেবেও না, দু নৌকায় পা দিয়ে থাকবার অসম্ভব লোভটা যদি সে একবার ত্যাগ করে।

 নির্মল নিরুত্তরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। শ্বশুরকে সে অনেকটা জানিত―এতটা জানিত না। এই শ্বশুর ষোড়শীর কল্যাণের পথ যাহা নির্দেশ করিয়া দিলেন, তাহাতে তর্ক করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত আর তাহার রহিল না।

 শাশুড়ীর দুধ গরম করিয়া আনিতে বিলম্ব হইল, তিনি ঘরে ঢুকিয়া স্বামীর পাতের কাছে বাটি নামাইয়া রাখিরা আহারের স্বল্পতার জন্য জামাতাকে মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন, এবং এই ত্রুটি সংশোধন করিবার ভার স্বয়ং গ্রহণ করিয়া অদূরে উপবেশন করিলেন।

 কর্তা দুধের বাটি মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া কহিলেন, কিন্তু মেয়েটার একটা প্রসংশা না করে পারা যায় না―বেটী বিদ্যের যেন সরস্বতী। জানে না এমন শাস্ত্রই নেই!

 গৃহিণী তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিলেন, তা আর বলতে! দেখেচ ত কাজকর্মে সে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার শিরোমণিঠাকুর ভয়ে যেন কেঁচো হয়ে যান। চলে গেলে বুড়োর মুখে সহস্রধারে ফোটে, কিন্তু সুমুখে নিন্দে করবার ভরসা পান না।

 কর্তা কহিলেন, না না, নিন্দে করবেন কেন, তিনি বরঞ্চ সুখ্যাতিই করেন।

 গৃহিণী নাকের মস্ত নথে একটা নাড়া দিয়া ততখানিই প্রতিবাদ করিলেন। বলিলেন, হাঁ, বুড়ো সেই পাত্র কিনা! হিংসেয় ফেটে মরেন, আবার সুখ্যাতি

১২৫