পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 আমার সময়মত দেখা করব বলো। বলিয়া সে বাটীর ভিতর প্রস্থান করিল।

 সায়াহ্নবেলায় জনার্দন রায় প্রস্তুত হইয়া আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া ডাক দিয়া কহিলেন, মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েচেন, তোমাকে তাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, যদি যাও ত আর বিলম্ব করোনা।

 নির্মল বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার যাওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?

 জনার্দন কহিলেন, যাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, তাঁরা নিশ্চয়ই করেন, এই বলিয় তিনি অগ্রসর হইলেন।

 সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই দেবীর আরতি শুরু হইল। মাতার বহুবিধ গৌরবের বস্তুই কালক্রমে বিরল হইয়া আসিতেছে, কিন্তু তাঁহার শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রীর সংখ্যা প্রাচীনকাল হইতে অদ্যাবধি তেমনি বজায় আছে। সেই সম্মিলিত তুমল বাদ্যনিনাদ নির্মল ঘরে বসিয়াই শুনিতে পাইল। কথা ছিল, আরতি শেষ হইলে পঞ্চায়েত বসিবে, অতএব সেই সুপবিত্র ধ্বনি থামিবার পর সে গৃহ হইতে যাত্রা করিল। মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিল আলোর বন্দোবস্ত বিশেষ কিছু নাই, প্রাঙ্গণমধ্যস্থিত নাট-বাঙ্গালায় গোটা দই লণ্ঠন মাঝখানে রাখিয়া একটা কোলাহল উঠিয়াছে এবং তাহাই বহুলোক ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া শনিতেছে। সেই অন্ধকারে নির্মলকে কেহ চিনিল না, সে জন-দুই লোকের কাঁধের উপর উঁকি মারিয়া দেখিল তথায় কে একজন বাবুগোছের ভদ্রলোক হাতমুখ নাড়িয়া কি-সব বলিতেছেন। কিছুই শোনা গেল না, কিন্তু মানুষের আগ্রহ দেখিয়া একথা বুঝা গেল, তিনি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর কাহারও নিন্দা ও গ্লানি করিতেছেন। এই ব্যক্তিই যে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী তাহা সে আন্দাজ করিল, অতএব বক্তব্যবস্তু যে ষোড়শীর জীবনচরিত তাহাতে সন্দেহ রইল না। ভিড় ঠেলিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইতে যদিচ তাহার প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু দুই একটা কথা শুনিবার লোভও সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে না পারিয়া পায়ের দুই আঙুলে ভর দিয়া উদ্‌গ্রীব হইয়া দাঁড়াইল। কয়েক মুহূর্তেই মনে লাগিয়া গেল, তখনও জীবানন্দ চৌধুরী আসল বস্তুতে অবতীর্ণ হয় নাই―ষোড়শীর মায়ের ইতিবৃত্তেরই আখ্যান চলিতেছিল, অবশ্য সমস্তই শোনা কথা। সাক্ষী তারাদাস অদূরে বসিয়া―এই সকল অসচ্চরিত্র স্ত্রীলোক দিগের সংস্রবে কিরূপে এই পীঠস্থান ক্রমশঃ ধীরে ধীরে অপবিত্র হইয়া উঠিতেছে এবং সমস্ত দেশের কল্যাণ তিরোহিত হইতেছে―

 পিছনে পিঠের উপর একটু চাপ পড়িতে ফিরিয়া দেখিল কে একজন অন্ধকারে অনুসরণ করিয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইতে নির্মল স্পষ্ট বুঝিতে পারিল এই সুগঠিত দীর্ঘ ঋজুদেহ ষোড়শী ভিন্ন আর কাহারও নহে। সে দ্বারের বাহিরে আসিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল এবং ঈষৎ একটু হাসিয়া অনুযোগের কণ্ঠে কহিল, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা-তা শুনছেন? কতগুলো কাপরুষ মিলে দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে―তাও আবার একজন মৃত আর একজন অনুপস্থিত। চলুন আমার

১২৮