পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঘাড় নাড়িয়া জানাইল যে সত্যই সে চলিয়া যাইবে।

 কবে যাবে?

 কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।

 কাল? কালই যেতে পারো? বলিয়া জীবানন্দ একেবারে স্তব্ধ হইয়া বসিল। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আশ্চর্য মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়। যাতে তুমি যাও, সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি, অথচ তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেলো। নির্মলবাবু, মস্ত লোক, মস্তবড় ব্যারিস্টার, তিনি আছেন তোমার পক্ষ নিয়ে―হাঙ্গামা বাধাবে, লড়াই শুরু হবে―আমরা জিতবো, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেছি, ও নিয়ে আর কোন গোলমাল হবে না―কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর তোমাকে ত যা বলব তাই করতে হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েছি, কিন্তু আর যে একটা দিক আছে―তুমি নিজেই সমস্ত ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিদায় নিলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে, তামাশাটা কোথায় গিয়ে গড়াবে, তা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি―আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে, আমার মত তোমারও ভুল হচ্চে―তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি?

 কথাগুলি এত চমৎকার এবং এমন নূতন যে হঠাৎ বিস্ময় লাগে ইহা জীবানন্দের মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে। জবাব দিতে ষোড়শীর একটু থামিতে হইল। শেষে সায় দিয়া বলিল, হতে পারে বৈ কি। শুধু এই খবরটা নিশ্চয় জানি, যা আমি স্থির করেচি সে আর অ-স্থির হবে না।

 জীবানন্দ বলিয়া উঠিল, বাপ রে বাপ! তোমার পুরুষমানুষ, আর আমার মেয়েমানুষ হওয়া উচিত ছিল? আচ্ছা, সেইখানেই বা তোমার চলবে কি করে?

 ষোড়শী পূর্বের মতই সহজ গলায় উত্তর দিল, এ আলোচনা আমি আপনার সঙ্গে কোনমতে করতে পারিনে।

 জীবানন্দ রাগ করিয়া বলিল, তুমি কিছুই পারো না, তুমি পাথর। চুলে আমার পাক ধরে এলো, আমি বুড়ো হয়ে গেলাম―তোমার কাছে কি এখন আমি হাতজোড় করে কাঁদতে পারি তুমি ভেবেচ?

 ষোড়শী কহিল, দেখুন অনেক রাত্রি হ’লো, এখনো আমার আহ্নিক পর্যন্ত সারা হয়নি―

 পুরোহিতের কাশি এবং পায়ের শব্দ বাহিরে শোনা গেল; সে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, সকলের সম্মুখে মন্দিরের দোর বন্ধ করে চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশাই, শিরোমণি―এঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

 ষোড়শী কহিল, ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাবো, বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।

 জীবানন্দ নিঃশব্দে উঠিয়া কহিল; এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছেই পাঠিয়ে দিয়ো।

১৩৭