পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করে রেখেছিলাম, হঠাৎ উনি যেন মাঝ থেকে চাবি হাত করবেন, সেটা আর খেয়াল করিনি। এখন সহজে দিলে হয়। দশ দিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না―একটি পাই পয়সা না।

 সকলে এ কথা স্বীকার করিল। অনেকের এমনও মনে হইল, ইহার চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।

 এই দল যথাসময়ে এবং যথোচিত সমারোহে যখন জমিদারের শান্তিকুঞ্জে আসিয়া উপস্থিত হইল, জমিদার তখন বাহিরের ঘরে বসিয়া। মদের বোতল ও গ্লাসের পরিবর্তে—জমিদারির মোটা মোটা খাতাপত্র তাঁহার সম্মুখে। একধারে বসিয়া তাঁহার সহচর প্রফুল্লচন্দ্র খবরের কাগজ পড়িতেছিল, সে-ই সকলকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল।

 শিরোমণি সকলের অগ্রে কথা কহেন, এবং সকলের শেষে অনুতাপ করেন; এ ক্ষেত্রেও তিনিই কথা কহিলেন, বলিলেন, হুজুরের পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়, তাই একটু বিলম্ব করেই আমরা সকলে―

 জীবানন্দ খাতাপত্র এক পাশে ঠেলিয়া রাখিয়া সহাস্যে কহিলেন, বিলম্ব না করে এলেও হুজুরের নিদ্রার ব্যাঘাত হতো না শিরোমণিমশায়, কারণ দিনের বেলা তিনি নিদ্রা দেন না।

 কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর―

 শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন যা সত্য নয়, এবং অনেক কথা বলেন যা মিথ্যে। এই যেমন আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা――, বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল। জীবানন্দ কহিলেন, কিন্তু যে জন্যে ত্বরা করে আসতে চেয়েছিলেন তার হেতুটা শুনি?

 জনার্দন রায় নিজেকে কথঞ্চিৎ সামলাইয়া লইলেন, মনে মনে কহিলেন, এত ভয়ই বা কিসের? প্রকাশ্যে বলিলেন, মন্দির সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল―

 জীবানন্দ কহিলেন, তিনি সোজা হলেন কি করে?

 এই ব্যঙ্গ জনার্দন অনভব করিলেন, কিন্তু শিরোমণি তাহার ধার দিয়াও গেলেন না, খুশী হইয়া সদর্পে কহিলেন, সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে যেতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর সইতে পারছিলেন না।

 জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তাই হবে! তার পরে?

 শিরোমণি বলিলেন, কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন―বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না? এই বলিয়া তিনি রায়মশায়কে হাত দিয়া ঠেলিলেন।

 জনার্দন চকিত হইয়া কহিলেন, মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েছি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেচেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে!

 জীবানন্দ সায় দিয়া কহিলেন, তা করেচে। জমাখরচের খাতাও একখানা

১৩৯