পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহার চিরদিনের মত হাতের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। কিসের জন্য বাটীর বাহির হইয়াছিল ঠিক স্মরণ করিতে পারিল না, ঝোঁকের মাথায় জোর করিয়া যখন ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়াছিল, তখন স্থিরসঙ্কল্প হয়ত কিছুই ছিল না, হয়ত অগোচরে অস্পষ্টরূপে অনেক কথাই ছিল―যাহা এখন একেবারে লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। গৃহত্যাগের কোন উদ্দেশ্যই মনে পড়িল না। কিন্তু গৃহে ফিরিতেও ইচ্ছা করিল না। কিছুদূর অগ্রসর হইয়া রাস্তা ছাড়িয়া পায়ে-হাঁটা যে পথটা মাঠের উপর দিয়া কোনাকুনি চণ্ডীগড়ের দক্ষিণ ঘুরিয়া গিয়াছে, অন্ধকারে সেই পথেই সে পা বাড়াইল। পথটা দীর্ঘ এবং বন্ধুর, প্রতি পদক্ষেপেই বাধা পাইতে লাগিল, কিন্তু ধাক্কা খাইয়া, হোঁচট খাইয়া পথ চলিতে চলিতে বিক্ষিপ্ত চিত্ততল তাহার কখন যে ইঁট, কাঠ, চুন এবং সুরকির চিন্তায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, সে জানিতেও পারিল না।

 জিনিসটা কিছুই নয়, ছোট একটা সাঁকো, বীজগ্রামের জমিদারের কাছে তাহার চেয়ে তুচ্ছ বস্তু আর ত কিছু হইতেই পারে না। সেটা তৈরি করার মধ্যে না আছে শিল্প, না আছে সৌন্দর্য; তবুও সেই শিল্পসৌন্দর্যহীন সামান্য বস্তুটাই যেন কত দুঃখীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশিয়া তাহার মনের মধ্যে আজ এক নতুন রসে ভরিয়া অসামান্য হইয়া দেখা দিল! তাহাকে কতপ্রকারে ভাঙ্গিয়া কতরকমে গড়িয়া সে যেন আর শেষ হইতেই চাহিল না! অথচ এ-সকল যে শুধু তাহার অবসন্ন মনের ক্ষণস্থায়ী খেয়াল, সত্যবস্তু নয়, কাল দিনের বেলা ইহার চিহ্নমাত্র রহিবে না এ কথাও সে বিস্মৃত হইল না, উৎসবের মাঝে গোপন শোকের মত কোথায় যেন বিঁধিয়াই রহিল। অথচ আজ রাত্রির মত এই ছেলেমানুষিটাকে সে কোনমতেই ছাড়িতে পারিল না, প্রশ্রয় দিয়া দিয়া সে কল্পনার পরে কল্পনা যোজনা করিয়া অবিশ্রাম চলিতে লাগিল।

 সহসা কালো আকাশপটে চণ্ডীমন্দিরের চূড়া দেখা দিল। এতদূরে আসিয়াছে তাহার হুঁশ ছিল না; আরও কাছে আসিয়া মন্দিরের ছোটা দরজাটা তখনও খোলা আছে দেখিতে পাইয়া নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করিল। দেবীর আরতি অনেকক্ষণ শেষ হইয়া গেছে, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ, সমস্ত প্রাঙ্গণ ঘোর অন্ধকার, শুধু নাটমন্দিরের একধারে মিটমিট করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছে। জীবানন্দ নিকটে গিয়া দেখিল জন চার-পাঁচ লোক মশার ভয়ে আগাগোড়া মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে, শুধু কে একজন থামের আড়ালে চুপ করিয়া বসিয়া মালা জপ করিতেছে। জীবানন্দ আরও একটু কাছে গিয়া লোকটিকে দেখিবার চেষ্টা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে তুমি?

 লোকটি জীবানন্দের ধপধপে সাদা পরিচ্ছদ অন্ধকারেও অনুভব করিয়া তাঁহাকে ভদ্রব্যক্তি বলিয়া বুঝিল; কহিল, আমি একজন যাত্রী বাবু।

 ওঃ―যাত্রী! কোথায় যাবে?

 আজ্ঞে, আমি যাবো শ্রীশ্রীপুরীধামে।

 কোথা থেকে আসচো? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী? এই বলিয়া জীবানন্দ ঘুমন্ত লোকগুলোকে দেখাইয়া দিল!

১৪৭