যোড়শী কহিল, তারা পারে, জমি তাদের। কিন্তু দেবতার সম্পত্তি বাঁধা দেবার বিক্রি করবার ত আমার অধিকার নেই।
জীবানন্দ একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ হাসিয়া বলিল, নেবার অধিকার কি ছাই আমারই আছে? এক কপর্দকও না। তবুও নিচ্ছি, কেননা আমার চাই। এই চাইটাই হচ্ছে সংসারের খাঁটি অধিকার। তোমার যখন দেওয়া চাই-ই তখন―
যোড়শী নিঃশব্দে স্থির হইয়া রহিল, জীবানন্দ কহিতে লাগিল, ভাবে মনে হয় তুমি লেখাপড়া কিছু জানো; তা যদি হয় ত জমিদারের প্রাপ্যটা নিয়ে আর হাঙ্গামা করো না―দিয়ো।
ষোড়শী এবার সাহস করিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, ওটা কি আপনি জমিদারের প্রাপ্য বলতে চান?
জীবানন্দ কহিল, প্রাপ্য বলতে চাইনে; ওটা তোমাদের দেয় এই বলতে চাই। তোমার মনে হতে পারে বটে, অন্য জমিদারকে ত দিতে হয়নি। তার কারণ, তাঁরা আমার মত সরল ছিলেন না। স্পষ্ট করে দাবী করেন নি, কিন্তু প্রায় সমস্ত গ্রামখানাই ধীরে ধীরে বেদখল করে নিয়েছেন। তাঁরা একরকম বুঝেছিলেন, আমি একরকম বুঝি। যাক, এত রাত্রে কি একা বাড়ি যেতে পারবে? যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে তাদের আর সঙ্গে দিতে চাইনে।
এতক্ষণ ও এতগুলো কথাবার্তায় ষোড়শীর ভয়টা কতকটা অভ্যাস হইয়া আসিতেছিল, সে সবিনয়ে কহিল, আপনার হকুম হলেই যেতে পারি।
জীবানন্দ সবিস্ময়ে কহিল, একলা? এই অন্ধকার রাত্রে? ভারী কষ্ট হবে যে। বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।
তাহার কথা ও হাসির ইঙ্গিত এতই স্পষ্ট যে, আশঙ্কা ষোড়শীর কমিতেছিল তাহাই একেবারে চতুর্গুণ হইয়া ফিরিয়া আসিল। সে মাথা নাড়িয়া ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিল, না, আমাকে এখুনি যেতেই হবে। বলিয়া পা বাড়াইবার উদ্যোগ করিতেই জীবানন্দ তেমনি সহাস্যে কহিল, বেশ ত টাকা না হয় নাই দেবে ষোড়শী। তা ছাড়া আরও অনেক রকমের সুবিধে―
কিন্তু প্রস্তাব শেষ হইতে পাইল না। ইহার মুখে নিজের নাম শুনিয়াই ষোড়শী অকস্মাৎ প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, আপনার টাকা আপনার সুবিধা আপনার থাক, আমাকে যেতে দিন। বলিয়াই সে যথার্থই এবার এক পা অগ্রসর হইয়া গেল। কিন্তু যে লোকগুলোকে এই লোকটাও তাহার সঙ্গে দিতে সাহস করে না তাহাদিগকেই সম্মুখে কিছু দূরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে আপনিই থমকিয়া দাঁড়াইল।
তাহার বাক্য ও কার্যের কোন প্রতিবাদ জমিদার করিল না কিন্তু তাঁহার মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তুমি মদ খাও?
ষোড়শী কহিল, না।
১৫