যাবার সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাবো।
ষোড়শী তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারিল না। জীবানন্দ কহিল, যাবার দিনে আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না অলকা। আমার জীবনের দাম তুমি ত জানো, আর হয়ত দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কত রকমে দয়া করে গেছ, আমার শেষ দিন পর্যন্ত আমি সেই-সব কথাই স্মরণ করব।
ষোড়শী কহিল, আচ্ছা আসুন―এই বলিয়া সে অগ্রসর হইল!
মিনিট-দই নিঃশব্দে চলার পরে জীবানন্দ কহিল, লোকে বলে, ও দয়ার যোগ্য নয়। আচ্ছা অলকা, দয়ার আবার যোগ্যতা অযোগ্যতা কি? দয়া যে করে সে ত নিজের গরজেই করে। নইলে, দয়া পাবার যোগ্যতা আমার ছিল এতবড় দোষারোপ করতে ত শুধু অতি-বড় শত্রু নয়, তুমি পর্যন্ত পারবে না।
ষোড়শী মৃদুস্বরে বলিল, আমার চেয়ে আপনার বড় শত্রু, সংসারে বুঝি আর কেউ নেই?
জীবানন্দ বলিল, না।
মন্দিরে প্রবেশ করার পরে জীবানন্দ হঠাৎ বলিয়া উঠিল, মজা দেখ অলকা, যাদের নিজের অন্ন নেই, সংসারে তারাই অপরের অন্নে সবচেয়ে বড় বাধা। ষোড়শী জিজ্ঞাসু-মুখে ফিরিয়া চাহিতে কহিল, আজ আমি এতক্ষণ পর্যন্ত এই মন্দিরেই বসে ছিলাম। ভৈরবী নেই, এখন জমিদার কর্তা। হুজুরের নাম করে তাই এরই মধ্যে যাত্রীদের উপর তে-রাত্রির আইন জারি হয়ে গেছে। তোমার সেই যে খোঁড়া অতথিটি পা না সারা পর্যন্ত যাকে তুমি থাকতে অনুমতি দিয়েছ, তার মুখেই শুনতে পেলাম হুজুরের কড়া হুকুম আজ তার অন্ন বন্ধ। সে বেচারা অভুক্ত বসে চণ্ডীনাম জপ করছিল―হুজুরের কল্যাণ হোক, কাল সকালেই নাকি আবার তাকে চলে যেতে হবে, পা-দুটো তার থাক আর না থাক!
ষোড়শী কহিল, আমার বাবা বুঝি হুকুম দিয়েছেন?
জীবানন্দ বলিল, শুধু তোমার বাবা কেন, গরীব-দুঃখীর প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য করতে অনেক বাবাই এ গ্রামে আছেন, আর হুজুরের নামে ত স্বর্গ-মর্ত্য ছেয়ে গেল। লোকটার কাছে বসে বসে তাই ভাবছিলাম অলকা, তোমার যাবার পরে সন্ন্যাসিনীর আসনে বসে এইসব বাবার দল যে তাণ্ডব-কাণ্ড বাধাবে তাকে আমি সামলাবো কি করে?
ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।
জীবানন্দ নিজেও বহুক্ষণ অবধি মৌন থাকিয়া মনে মনে কত কি যেন ভাবিতে লাগিল, অকস্মাৎ একসময়ে বলিয়া উঠিল, তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?
ষোড়শী শান্তকণ্ঠে শুধু কহিল, না। তার পরে সে উঠিয়া রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রণাম করিয়া যখন ফিরিয়া আসিল, জীবানন্দ কহিল, আর একটা দিন?
১৫২