পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, এটা সত্যি যে খায় না। সূর্যদেব পশ্চিমে ওঠাও সহজ―কিন্তু কি জানেন রায়মশাই, ভয়ানক একগুঁয়ে লোক―সেদিন সারাদিনের যন্ত্রণায় রাত্রে হাত-পা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এলো, ডাক্তারবাবু ভয় পেয়ে বললেন, আমার কথা রেখে অন্ততঃ এক-চামচে খান―হার্ট ফেল করতে পারে―বাবুর কিছু ভয়ই হলো না। একটু হেসে বললেন, এতকালের মধ্যে ও-বেচারা কখ্‌খনো ফেল করেনি, সমানে চলেছে, আজ যদি একদিন করেই ফেলে ত আর দোষ দেব না, কিন্তু আমি জীবনভোরই ফেল করে আসচি, আজ অন্ততঃ একটা দিনও আমাকে পাশ করতে দিন। কেউ খাওয়াতে পারলে না।

 বল কি!

 এককড়ি কহিল, খেয়াল চেপেছে বাড়ি মেরামত থাক, ওই টাকায় মাঠের মাঝখানে এক সাঁকো, আর রূপসী বিলের উত্তরধারে একটা মস্ত বাঁধ তুলতে হবে। ইঞ্জিনিয়রবাবু এসেছিলেন, হিসেব করে বললেন, ও টাকায় দশখানা বাড়ি মেরামত হতে পারে। তার একভাগ এদিকে দিয়ে বাড়িটা রক্ষা করুন; কিন্তু কিছুতেই না। দেওয়ানজী বাপের বয়সী বুড়োমানুষ, বললেন, জমিদারি বাঁধা পড়বে যে! বাবু বললেন, প্রজারা সব বছর বছর খাজনা যোগাচ্চে আর মরচে। তাদের জমি বাঁচাবার জন্যে যদি জমিদারি বাঁধা পড়ে ত পড়ুক না। ও শোধ করা যাবে।

 রায়মশায় চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিলেন, মাথা-খারাপ-টারাপ হয়নি ত?

 ইহার দিন-দুই পরে খবর লইয়া যখন জনার্দন জানিতে পারিলেন, এককড়ি আজও সে কথা হুজুরে পেশ করে নাই, তখন তিনি বিচলিত হইয়া উঠিলেন। অপদার্থ ও ভীতু বলিয়া মনে মনে তাহাকে তিরস্কার করিলেন এবং রাত্রে সুনিদ্রা হইল না। সায়েব হঠাৎ যদি একদিন এত্তেলা পাঠাইয়া সরজমিনে আসিয়া পড়ে ত বিপদের অবধি থাকিবে না। সকল দিকে প্রস্তুত না থাকিলে কি যে ঘটিতে পারে বলা যায় না। স্থির করিলেন, পরদিন দেখা করিয়া নিজেই সকল কথা নিবেদন করিবেন―পরের উপর নির্ভর করিয়া সময় নষ্ট করিলে মরিতে হইবে।

 সকালে একশত আটবার দুর্গানাম জপ করিলেন, শ্রীশ্রীচণ্ডীমাতার নাম লাল কালি দিয়া কাগজের উপরে লিখিয়া কাজটা পাকা করিয়া লইলেন এবং হাঁচি, টিকটিকি, শূন্যকুম্ভ প্রভৃতি সর্বপ্রকার বিপত্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া মোটা দেখিয়া জন-চারেক লোক সঙ্গে করিয়া জমিদারের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। কিন্তু অধিক দূরে অগ্রসর হইতে হইল না, জন পাঁচ-ছয় লোক ছুটিয়া আসিয়া যে খবর দিল, তাহা যেমন অপ্রীতিকর, তেমনি অপ্রত্যাশিত। বেশী নয়, কাঠা-দশেক পরিমাণ বড় রাস্তার উপরেই একটা জায়গা কিছুকাল হইতে রায়মহাশয় দখল করিয়া ঘিরিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, দোকান-ঘরটা এইখানে সরাইয়া আনিবেন। সম্পত্তি চণ্ডীর এবং এই লইয়া ষোড়শীর সহিত তাঁহার বাদানুবাদও হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পরাক্রান্ত জনার্দন রায়কে সে বাধা দিতে পারে নাই। এ সম্বন্ধে তাঁহার কি একটা দলিলও ছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেরা তাহা বিশ্বাস করিত

১৬৪