আটাশ
অকস্মাৎ দিনকয়েকের অবিশ্রান্ত বারিপাতে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম এমন অচল হইয়া গেল যে, অপ্রতিহত-গতি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁহার তদন্তের চাকাটাকে ঠেলিয়া আনিতে পারিলেন না। তবে তাহার হুকুম ছিল, বর্ষণ কমিলেই তিনি চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিবেন, এবং সেই হুকুম তামিলের দিন পড়িয়াছে আজ। খবর পৌঁছিয়াছে, গ্রামের বাহিরে বারুইয়ের তীরে তাঁহার তাঁবু খাটানো হইতেছে, মুরগী আণ্ডা, দুধ ঘি প্রভৃতি যোগান দেওয়ার কাজে এককড়ি প্রাণপাত পরিশ্রম করিতেছে এবং খুব সম্ভব দ্বিপ্রহরের দিকেই চণ্ডীগড়ে তাঁহার পদধূলি পড়িবে।
শেষ রাত্রি হইতেই বর্ষণ থামিয়াছে, কিন্তু আকাশের চেহারা বদলায় নাই! এ মূর্তি দেখিয়া জোর করিয়া বলিবার জো নাই দুর্যোগ থামিল, কিংবা আবার চারিদিক আকুল করিয়া আসিবে। বাড়ি পোড়ার পরে, বাহিরের দিকে যে দ্বিতল ঘর দুখানিতে জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছিল, তাহারই একটি ক্ষুদ্র বারান্দায় ক্যাম্পখাট পাতিয়া সে সকালবেলায় বারুইয়ের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া ছিল। পাহাড়ের ঘোলা জল নামিয়া নদীর সেই শীর্ণ দেহ আর নাই; উদ্দাম স্রোত তটপ্রান্তে সবেগে আঘাত করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে―জীবানন্দ কত কী যে ভাবিতেছিল তাহার ঠিকানা নাই। জ্বর এবং তার আজন্ম বক্ষশূল কমিয়াছে, কিন্তু সারে নাই। আজও সে শয্যাশায়ী, উঠিতে হাঁটিতে পারে না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পৌঁছানোর খবর পাইলে সে পালকিতে করিয়া নিজে গিয়া দেখা করিবে। মিথ্যা কিছুই বলিব না তাহা সে স্থির করিয়াছে―যেমন করিয়া মদ-ছাড়া সে স্থির করিয়াছিল, ঠিক তেমনি করিয়া; যেমন করিয়া সে সঙ্কল্প স্থির করিয়াছিল, এ জীবনে দুঃখ কাহাকেও আর দিবে না, ঠিক তেমনি করিয়া ইহাও সে স্থির করিয়াছিল। কিন্তু আজ যথার্থই তাহার কাহার বিরুদ্ধেও কোন নালিশ ছিল না; সে মনে মনে এই বলিয়া তর্ক করিতেছিল যে, অপরাধ ত মানুষই করে, অন্যায় ত মানুষের জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে, সুতরাং তাহার সাক্ষ্যে সে ছাড়া আর কেহ শাস্তি পাইবে চিন্তা করিয়া সে বাস্তবিক বেদনা বোধ করিতেছিল। কি করিয়া বলিলে যে কাহারও কোন ক্ষতি হয় না, এই কথাই যে কতরূপে আলোচনা করিতেছিল তাহার নির্দেশ নাই। কিন্তু কোন বিষয়ই সুশৃঙ্খলায় শেষ পর্যন্ত ভাবিবার মত অবস্থা তাহার ছিল না, তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল একই সমস্যা একই মীমাংসা লইয়া বার বার তাহার সুমুখে আসিতেছিল। এই লইয়া সে যখন প্রায় হয়রান হইয়া উঠিয়াছিল, এমনি সময়ে সম্পূর্ণ একটা নূতন জিনিসের উপর গিয়া তাহার মন এবং দৃষ্টি একই সময়ে স্থিতিলাভ করিল। একখানা ছোট নৌকা স্রোতের অনুকূলে অত্যন্ত দ্রুতবেগে আসিতেছিল, এবং তাহার বাটীর সম্মুখে উপস্থিত হইবামাত্রই মাঝি ডাঙ্গার উপরে নোঙ্গর ছুড়িয়া ফেলিয়া তাহার গতিরোধ করিল। এ নদীতে নৌকা চলাচল অত্যন্ত বিরল। বৎসরের অধিকাংশ দিন যথেষ্ট জল থাকে না বলিয়াই শুধু নয়, বর্ষাকালেও খরস্রোতে যাতায়াতের
১৭৪