পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ষোড়শী তেমনি মাথা নাড়িয়া শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলিল, হাঁ, সমস্ত রাত্রিই আমার কাজ ছিল। ওঁর অসুখ করেছিল বলে বাড়ি ফিরে যেতে পারিনি।

 তারাদাস চেঁচাইয়া বলিল, বিশ্বাস করবেন না হুজুর, সমস্ত মিছে, সমস্ত বানানো। আগাগোড়া শিখানো কথা।

 সাহেব তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া শুধু মুখ টিপিয়া একটু হাসিলেন, এবং শিস্‌ দিতে দিতে প্রথমে বন্দুকটা এবং পরে রিভলভার দুটো বেশ করিয়া পরীক্ষা করিয়া জীবানন্দকে কেবল বলিলেন, আশা করি এ-সকল রাখবার আপনার হুকুম আছে? এবং তারপর ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

 বাহির হইতে তাঁহার গলা শোনা গেল, হামারা ঘোড়া লাও, এবং ক্ষণেক পরেই ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে বুঝা গেল, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব বাড়ি হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন।

পাঁচ

 ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া আসিল, পুলিশ-কর্মচারীও আপনার অনুচরগণকে স্থানত্যাগের ইঙ্গিত জ্ঞাপন করিলেন―এইবার তারদাসের নিজের অবস্থাটা তাহার কাছে প্রকট হইয়া উঠিল। এতক্ষণ সে যেন এক মোহাবৃত প্রগাঢ় কুহেলিকার মধ্যে দাঁড়াইয়াছিল, হঠাৎ মধ্যাহ্ন-সূর্যকিরণে তাহার বাষ্পটুকু পর্যন্ত উড়িয়া গিয়া দুঃখের আকাশ একেবারে দিগন্ত ব্যাপিয়া ধূ ধূ করিতে লাগিল। যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও ছায়া, কোথাও আশ্রয়, কোথাও লুকাইবার স্থান নাই―কেবল সে আর তাহার মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়াইয়া দাঁত মেলিয়া হাসিতেছে।

 সমস্ত জেলার যিনি ভাগবিধাতা, তাহার অনুগ্রহ ও অনুকম্পা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ও আশাতীত সুলভ লাভ করিয়া কল্পনা তাহার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া উঠিয়াছিল। মনে করিয়াছিল এ কেবল ওই অত্যাচারী মাতালটাকে হাতে হাতে ধরাইয়া দেওয়াই নয়, এ তাহার ভাগ্যলক্ষ্মীর অপর্যাপ্ত দান। তাঁহার বরহস্তের দশ অঙ্গুলির ফাঁকে ফাঁকে আজ যে বস্তু ঝরিয়া পড়িবে, সে শুধু এই জমিদারগোষ্ঠীর সর্বনাশ নয়, এ তাহার জমিজমা ও টাকা-মোহরের রাশি। তাহার একমাত্র আশঙ্কা ছিল, পাছে না তাহারা সময়ে পৌঁছিতে পারে, পাছে সংবাদ দিয়া কেহ পূর্বাহ্নেই সতর্ক করিয়া দেয়; এবং এ-পক্ষে তাহার চিন্তা, পরিশ্রম ও উদ্যমের অবধি ছিল না। ইহার বিফলতার দণ্ডও সে যে না ভাবিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু সে নিষ্ফলতা পৌঁছিল যখন এই দিক দিয়া, ষোড়শীর স্বহস্তের আঘাতেই যখন কামনার এববড় পাষাণ-প্রাসাদ ভিত্তিসমেত ধুলিসাৎ হইয়া গেল, তখন প্রথমটা তারাদাস মূঢ়ের মত চেঁচামেচি করিল, তারপর হতজ্ঞানের ন্যায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ অভিভূতভাবে দাঁড়াইয়া অকস্মাৎ এক বুকফাটা

২২