পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু থাক ওসব বিশ্রী আলোচনা। আপনাকে ত এইমাত্র বলেছি, আজ আর সেই তুচ্ছ টাকা-ক’টার মূল্য-নিরূপণ সম্ভব হবে না, কিন্তু ওইমাত্র ছিল অলকার মায়ের জীবনের সঞ্চয়। মেয়ের কোন একটা সদগতি করবার ও-ছাড়া আর কিছু যখন তাঁর হাতে ছিল না, তখন টাকা-ক’টির সঙ্গে মেয়েটাকেও আপনারই হাতে দিতে হলো। কিন্তু বিবাহ ত আপনি করেন নি, করেছিলেন শুধু একটু তামাশা। সম্প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, এই বোধ হয় তারপরে কাল প্রথম দেখা।

 জীবানন্দ কহিল, কিন্তু তারপরে ত তোমার সত্যিকারের বিবাহই হয়েচে শুনেছি।

 ষোড়শী ধৈর্য হারাইল না। তেমনি শান্ত গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, তার মানে আর একজনের সঙ্গে? এই না? কিন্তু নিরপরাধ নিরুপায় বালিকার ভাগ্যে এ বিড়ম্বনা যদি ঘটেই থাকে, তবু ত আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।

 জীবনন্দ কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, ষোড়শী, তখন তুমি ছেলেমানুষ ছিলে, অনেক কথাই ঠিক জানো না। তোমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তিনি সাক্ষী দিতেন―তিনি সত্যি কি চেয়েছিলেন। তোমার বাবাকে আজকের পূর্বে কখনো দেখিনি, কেবল সেই সম্প্রদানের রাত্রে নামটা মাত্র শুনেছিলাম। কিন্তু তিনিই যে তারাদাস, তুমিই যে অলকা, সে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।

 ষোড়শী ভাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিল, আজও ত কল্পনা করবার প্রয়োজন নেই।

 জীবনন্দ কহিল, নাই থাক, কিন্তু তোমার মা জানতেন শুধু কেবল তোমাকে তোমার বাবার হাত থেকে আলাদা রাখবার জন্যেই তিনি যা হোক একটা―

 বিবাহের গণ্ডি টেনে রেখেছিলেন? তা হবেও বা। অলকার মাও বেঁচে নেই, অলকাই আমি কিনা তা নিয়েও আপনার দুশ্চিন্তা করার আবশ্যক নেই। কিন্তু কেন যে ওদের সঙ্গে গেলুম না, কেন যে নিজের সর্বনাশের কোথাও কিছু বাকী রাখলুম না, সেই কথাটাই আজ আপনাকে বলে যাব। কাল আপনার সন্দেহ হয়েছিল হয়ত বা আমি লেখাপড়া জানি; লিখতে-পড়তে ত ওই এককড়িও জানে, সে নয়, কিন্তু আমার যিনি গুরু, তিনি হাতে রেখে কিছু দান করেন না, তাই আজ তাঁরই পায়ে নিজেকে এমন করে বলি দিতেও আমার বাধল না।

 জীবানদ কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে থাকিয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলিয়া বলিল, কিন্তু ধর, আসল কথা যদি তুমি প্রকাশ করে বল, তা হলে―

 ষোড়শী তৎক্ষণাৎ কহিল, আসল কথাটা কি? বিবাহের কথা। কিন্তু সেই ত মিথ্যে। বিয়ে ত হয়নি। তা ছাড়া, সে সমস্যা অলকার, আমার নয়! আমি সারারাত এখানে কাটিয়ে গিয়ে ও গল্প করলে সর্বনাশের পরিমাণ তাতে এতটুকু কমবে না। কিন্তু ও কথা ত আর আমি ভাবচি নে। আমার বড় দুঃখ এখন আর আমি নিজে নয়—সে আপনি। কাল ভেবেছিলাম আপনার বুঝি সাহসের আর অন্ত নেই—নিজের প্রাণটাও বুঝি তার কাছে ছোট, কিন্তু আজ দেখতে পেলাম, সে ভুল। শুধু যে এক নিরপরাধ নারীর কলঙ্কের মুল্যেই আজ নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন তাই নয়, একদিন যে অনাথ মেয়েটিকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়েই কেবল আত্মরক্ষা করেছিলেন,

২৬