পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ডাক্তারবাবু, বকশিসের কথা ছেড়েই দিন―আমরা সবাই আপনার কেনা হয়ে থাকব।

 ডাক্তার নীরবে আসিয়া শয্যাপ্রান্তে উপস্থিত হইলেন, এবং পকেট হইতে কাঠের চোঙ্গাটা বাহির করিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে রোগ পরীক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন। বিস্তর ঘষামাজা করিয়া তিনি বেশ বড় ডাক্তারের মতই রায় দিলেন―অত্যাচার করিয়া রোগ জন্মিয়াছে, সাবধান না হইলে প্লীহা কিংবা লিভার পাকা অসম্ভব নয় এবং তাহাতে ভয়ের বথাও আছে। কিন্তু সাবধান হইলে নাও পাকিতে পারে, এবং তাহাতে ভয়ও কম। তবে এ কথা নিশ্চয় যে ঔষধ খাওয়া আবশ্যক।

 জীবানন্দ প্রশ্ন করিলেন, এ অবস্থায় কলকাতায় যাওয়া সম্ভব কিনা বলতে পারেন?

 ডাক্তার কহিলেন, যদি যেতে পারেন, তা হলে সম্ভব, নইলে কিছুতেই সম্ভব নয়।

 জীবানন্দ পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানে থাকলে ভাল হবে কি না বলতে পারেন।

 ডাক্তার অত্যন্ত বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়া জবাব দিলেন, অজ্ঞে না হুজুর, তা বলতে পারিনে। তবে, এ কথা নিশ্চয় যে, এখানে থাকলে ভাল হতে পারেন, আবার কলকাতা গিয়ে ভাল নাও হতে পারেন।

 জীবানন্দ মনে মনে বিরক্ত হইয়া আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করিলেন না। ডাক্তার ঔষধের জন্য লোক পাঠাইবার ইঙ্গিত করিয়া উপযুক্ত দর্শনী লইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 এককড়ি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া দ্বারের বাইরে পর্যন্ত আসিয়া ফিরিয়া গেলে জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, কি হবে এককড়ি?

 এককড়ি সাহস দিয়া বলিল, ভয় কি হুজুর, ওষুধ এলো বলে। বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্সচার খেলেই সব ভাল হয়ে যাবে।

 জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না এককড়ি তোমাদের বল্লভের মিক্সচার তোমাদেরই থাক, আমাকে তুমি কেবল কলকাতা যাবার একটা বন্দোবস্ত আজই করে দাও। এই বলিয়া তিনি যে দ্বার দিয়া ষোড়শী কয়েক মুহূর্ত পূর্বে অন্যত্র সরিয়া গিয়াছিল, সেইদিকে উৎসুকচক্ষে চাহিয়া রহিল।

 কিন্তু কেহই ফিরিয়া আসিল না। মিনিট দু-তিন পরে তাঁহার অধৈর্য আর মন মানিল না, কহিলেন, ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে তুমি যাবার একটা ব্যবস্থা কর গে এককড়ি। আজ যাওয়া আমার চাই-ই।

 এ সঙ্কেত এককড়ি চক্ষের নিমিষে বুঝিল, এবং যে আজ্ঞে হুজুর, বলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। কিন্তু ফিরিয়া আসিতে তাহার বিলম্ব হইতে লাগিল, এবং মিনিট-পনর বিলম্বে যখন সে যথার্থই আসিল, তখন একাকীই আসিল; কহিল, তিনি নেই, বাড়ি চলে গেছেন হুজুর।

 জীবানন্দ বিশ্বাস করিতে পারিল না। ব্যগ্র-ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আমাকে না জানিয়ে চলে যাবেন? এমন হতেই পারে না এককড়ি।

 বিশ্বাস করা সত্যই কঠিন। অলকা কোন ব্যবস্থা না করিয়াই চলিয়া গেল, একটা

৩২