পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শিরোমণি বলিয়া উঠিলেন, বাবা নির্মল, জানার আর বাকী কোথাও কিছুই নেই―কি বল মা, এখনও কি তোমার সন্দেহ আছে। তা ছাড়া তার মা―সেই যে একটা মস্ত কথা। এই বলিয়া তিনি হৈমর দিকে বিশেষ একটু কটাক্ষ করিলেন।

 হৈম অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহার সলজ্জ নীরবতায় ইহাই সকলে অনুভব করিলেন যে, সে ভৈরবীর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ করিতে লজ্জা এবং সঙ্কোচ বোধ করিতেছে, কিন্তু তাহার সম্বন্ধে ভাল কথা বলিবারও তাহার কিছুই নাই।

 জনার্দন কন্যাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মা, সমস্ত দিন উপোস করে তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে, যাও, তুমি বাড়ির ভেতরে যাও। ভৈরবীকে ডাকতে লোক পাঠানো হয়েছে, যদি আসে তোমাকে খবর দেবো।

 হৈম চলিয়া যাইতেছিল, এমন সময়ে যে লোকটা ডাকিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া যাহা জানাইল তাহার সারমর্ম এই যে, ভৈরবী কেবল যে তাহার প্রজা দিগম্বর ও বিপিনকে দিয়া তালা ভাঙ্গাইয়া সমস্ত ঘরগুলো দখল করাইয়া লইয়াছেন তাই নয় রায়মহাশয়ের হুকুম অগ্রাহ্য করিয়া এখানে আসিতেও সম্মত হন নাই। শুধু কেবল ফকির-সাহেবের অনুরোধেই অবশেষে স্বীকার করিয়াছেন। বোধ হয় দশ-পনর মিনিটের মধ্যেই আসিতে পারেন।

 বোধ হয় আসিতে পারেন! তা বটে! জ্বলন্ত অঙ্গারে ঘৃতাহুতি পড়িল এবং সামান্য একটা স্ত্রীলোকের অভাবনীয় দুঃসাহস ও স্পর্ধায় সম্ভ্রান্ত পুরুষগুলির মুখ দিয়া যে-সকল শব্দ ও বাক্যাবলীর প্রবাহ নিঃসৃত হইল তাহার আদ্যোপান্ত উল্লেখ করিয়াও একটা কথা বলা আবশ্যক যে, এই ভ্রষ্টা নারীকে কেবল এই মুহূর্তে গ্রাম থেকে বিদূরিত করা নয়, ইহাকে তালাভাঙ্গা ও অনধিকার প্রবেশের জন্য পুলিশের হাতে দিয়া জেল খাটানোর প্রাণজনীয়তা তাঁহারা অসংশয়ে প্রকাশ করিলেন। শুধু জামাতাবাবাজীই এই কোলাহলে যোগদান করিলেন না, খুব সম্ভব, তিনি তাঁহার সাহেবী ও ব্যারিস্টারী এই উভয় মর্যাদা রক্ষা করিতেই গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন।

 কোলাহল কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে জামাতাসাহেব প্রশ্ন করিলেন, এই ফকিরসাহেবটি কে? হঠাৎ ইনি জুটলেন কি করে?

 ইহার সম্বন্ধে নানা জনে নানা অভিমত প্রকাশ করিলেন। শিরোমণি তাহার শিরোদ্ধার করিয়া কহিলেন, ভালো না ছাই! মোচলমান আবার সিদ্ধপুরুষ। সে সব কিছু নয়, তবে লোকটা কারও মদ-টন্দ করে না। বারুইয়ের ওপর একটা বটগাছের তলায় আড্ডা; অনেককাল আছে―তবে মাঝে মাঝে কোথায় যায়, আবার আসে। মাস দুই ছিল না, এবার শুনচি নাকি দিন পাঁচ-ছয় হলো ফিরেচে। হয়ত ওরই মতলবে তালা ভেঙ্গেচে। বলা কিছু যায় না―হাজার হোক ম্লেচ্ছ ত!

 জামাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু আজ এলেন কি করে?

 তারাদাস এতক্ষণ নীরবেই ছিল, এবার কথা কহিল। বলিল, ওপারের ওই বটগাছের সঙ্গে জায়গাগুলো সব মা-চণ্ডীর। তাই থেকে আলাপ। ফকিরসাহেব

৪৫