বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তাঁহার উত্তর এবং সেটা বলিবার ভঙ্গীতে ব্যারিস্টার-সাহেব হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, এদের নালিশ এই যে, বর্তমান ভৈরবী যে অপরাধ করেছেন তাতে দেবীর সেবায়েত হবার সম্পূর্ণ অনধিকারী। উনি তার কিছু সাফাই দিতে পারেন কি? বলিয়া তিনি ষোড়শীর আনত মুখের প্রতি একবার কটাক্ষে চাহিয়া লইলেন।

 ফকির কহিলেন, ওঁকে আসামী করেই আপনাদের সুমুখে দাঁড় করিয়েচি, আবার অপরাধ অপ্রমাণ করবার বোঝাটাও ওঁকেই বইতে অনুরোধ করব, এতবড় জুলুম ত আমি পেরে উঠব না বাবুসাহেব।

 ব্যারিস্টার-সাহেব মনে মনে লজ্জিত হইয়া নীরব হইলেন, কিন্তু শিরোমণি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী যে ভৈরবীকে পেয়াদা দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে সারা রাত আটকে রেখেছিল, সে আমরা সবাই জানি; তবে কেন সে সকালে ম্যাজিষ্টার-সায়েবের কাছে মিছে কথা বললে যে, সে স্ব-ইচ্ছায় গিয়েছিল, আর জমিদারের অসুখ হলো বলেই সমস্ত রাত্রি নিজের ইচ্ছায় সেখানে ছিল? ও যদি নিষ্পাপ ত এ কথার জবাব দিক।

 ফকির জবাব দিলেন, কহিলেন, জমিদারের অত্যাচার ও অনাচারে উনি যে রাগের মাথায় নিজেই গিয়েছিলেন এ কথা মিথ্যে নয় শিরোমণিমশাই? এবং তিনি যে হঠাৎ ভয়ানক অসুস্থ হয়েছিলেন, এ ঘটনাও সত্য।

 জনার্দন রায় এতক্ষণ নীরবেই মস্ত বাদানুবাদ শুনিতেছিলেন, আর সহিতে পারিলেন না, বলিয়া উঠিলেন, এই যদি সত্য হয় ফকিরসাহেব, ত নিজের বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অত্যাচারীকে বাঁচাবার কি প্রয়োজন হয়েছিল? তাঁর অসুখ ত ওর কি? অসুখে সেবা করবার জন্য ত বীজগাঁয়ের জমিদার পালকি পাঠিয়ে নিয়ে যায়নি। মোট কথা আমরা ওকে রাখব না―আমরা ভিতরের ব্যাপার জানি। তা ছাড়া, ওর যদি কিছু বলার থাকে ওকেই বলতে দিন। আপনি মুসলমান, বিদেশী, হিন্দুধর্মের মাঝখানে পড়ে মধ্যস্থ হবার দরকার নেই!

 তাঁহার কথার ঝাঁজ এবং তীক্ষ্ণতা কিছুক্ষণ অবধি যেন ঘর ভরিয়ে রি-রি করিয়া বাজিতে লাগিল। ব্যারিস্টার-সাহেব নিজেও কেমন একপ্রকার অস্বচ্ছন্দ এবং অপ্রতিভ হইয়া উঠিলেন, এবং বাক্যহীন ভৈরবী নিস্তব্ধ বক্ষঃকুহরেও কি একটা উত্তর বাহিরে আসিবার জন্য বার বার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। ইহারই চিহ্ন ফকিরসাহেব ষোড়শীর মুখের উপর চক্ষের পলকে অনুভব করিয়া শুধু একটুখানি হাসিলেন, তার পরে জনার্দন রায়কে লক্ষ্য করিয়া হাসিমুখে বলিলেন, রায়মশায়, অনেকদিনের কথা হলো, আপনার হয়ত মনে নেই, মন্দিরের দক্ষিণে ঐ যে বড়ো নিমগাছটা, তারই তলায় তখন থাকি। ষোড়শী তখন এতটুকু মেয়ে, তখন থেকেই মা বলে ডাকি মুসলমান হয়েও যে ভুলটা করে ফেলেচি সেটা আজ আমাকে মাপ করতে হবে। সেই মায়ের এতবড় বিপদে কি না এসে থাকতে পারি? মা জিনিসটা ত তুচ্ছ নয়। তা না হলে আজই সকালে যখন ওঁরই মুখ থেকে ওঁর মায়ের লজ্জার কাহিনী টেনে বার করতে চেয়েছিলেন, তখন আপনার নিজের এই মা’টির কাছে ধমক খেয়ে অমন বিহ্বল

৪৮