পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইল না শুনিয়া শাশুড়ী ঠাকুরানী আশ্চর্য হইলেন, উদ্বিগ্ন হইলেন এবং ততোধিক খুশী হইয়া উঠিলেন, কিন্তু বাহিরের ঘরে বসিয়া শ্বশুর মহাশয় শুধু একটা হুঁ বলিয়াই তামাক টানিতে লাগিলেন। তিনি আশ্চর্যও হইলেন না, উদ্বিগ্নও হইলেন না এবং যাহার কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান আছে, সে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া খুশীর কথা মুখে আনিবে না।

 মকদ্দমার ব্যবস্থা করিতে নির্মল তার করিয়া দিল এবং কাজটা যে কেবল নিরর্থক নয়―মন্দ, তাহাও সে মনে মনে বুঝিল, তবুও সেই মনটাই তাহার সারাদিন একান্ত সংগোপনে সেই দিনান্তের জন্যই উন্মুখ হইয়া রহিল। বিগত রাত্রির হৈমর কান্নাটা যে কত হাস্যাস্পদ, কত অসম্ভব অপেক্ষাও অসম্ভব, সমস্ত দিন ধরিয়া এ কথা তার বহুবার মনে হইয়াছে, তবুও সেই একফোঁটা চোখের জল যেন কোনোমতেই আর শুকাইতে চাহিল না এবং প্রতি মুহূর্তেই সে এমনই একটা অজ্ঞাত ও অচিন্ত্যপূর্ব রহস্যের সৃষ্টি করিয়া চলিল, যাহা একই কালে মাধুর্য ও তিক্ততায় মিশিয়া একাত্ম হইয়া উঠিতে লাগিল।

 রাত্রির অন্ধকারেও পিতার চক্ষুকে ফাঁকি দিবার প্রয়াস নিষ্ফল বুঝিয়া হৈম স্বামী ও তাহার পশ্চিমা চাকরটাকে সঙ্গে করিয়া যখন ষোড়শীর নূতন বাসার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন সন্ধ্যা হয় নাই। ষোড়শী একখানি কম্বলের উপর বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে কি একখানা বই পড়িতেছিল, সম্মুখে জুতার শব্দ শুনিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আসুন। এস দিদি, এস। বলিয়া সে গুটানো কম্বলখানি প্রসারিত করিয়া পাতিয়া দিল।

 আসন গ্রহণ করিয়া স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া হৈম কহিল, দিদির এই নতুন ঘরখানির আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণি মশাই এমন কি আমার বাবা পর্যন্ত দিতে পারবে না। এই আশ্চর্য বস্তুটি দেখাবার লোভেই আজ এঁকে ধরে রেখেছি, নইলে আমাকে সুদ্ধ নিয়ে দুপুরের গাড়িতে চলে গিয়েছিলেন আর কি! স্বামীকে কহিল, কেমন, এ না দেখে গেলে অনুতাপ করতে হ’তো।

 নির্মল কহিল, দেখেও ত কিছু কম করতে হবে মনে হয় না।

 হৈম স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভাল। তাহার পর ষোড়শীর শান্ত মলিন মুখখানির উপর নিজের স্নিগ্ধ চোখদুটি রাখিয়া বলিল, আমরা সমস্তই শুনেচি। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে তুমি ত থাকতে পারবে না। আবেগে ও করুণায় শেষ দিকটায় তাহার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া গেল।

 কিন্তু ষোড়শীর গলায় ইহার প্রতিধ্বনি বাজিল না। সে অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, অভ্যাস হয়ে যাবে। এর চেয়ে কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই? তা ছাড়া, বাবার বড় কষ্ট হচ্ছিল।

 হৈম প্রশ্ন করিল, তা হলে সমস্তই ছেড়ে দিলে?

৬৬