কেবল যে দেবীর সেবিকা সে, সেই চণ্ডীর উদ্দেশ্যে আর একবার যুক্তকরে নতশিরে কহিল, মা, বৃথা চিন্তায় সময় বয়ে গেল, তুমি ক্ষমা করো।
রাত্রি কত হইয়াছে ঠিক জানিবার জো নাই, কিন্তু অনুমান করিলে অনেক হইয়াছে! তাই শয্যাটুকু আরও একটু বিস্তৃত করিয়া এবং প্রদীপে আরও খানিকটা তেল ঢালিয়া দিয়া সে শুইয়া পড়িল। শ্রান্তচক্ষে ঘুম আসিতেও বোধ করি বিলম্ব ঘটিত না; কিন্তু বাহিরে দ্বারের কাছেই একটা শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া বসিল। বাতাসেও একটু জোর ধরিয়াছিল শিয়াল-কুকুর হওয়াও অসম্ভব নয়, তবুও ক্ষণকাল কান পাতিয়া থাকিয়া সভয়ে কহিল, কে?
বাহির হইতে সাড়া আসিল, ভয় নেই, মা, তুমি ঘুমোও—আমি সাগর।
কিন্তু এত রাত্তিরে তুই কেন রে?
সাগর কহিল, হরখুড়ো বলে দিলে, জমিদার এয়েছে, রাতটাও বড় ভাল নয়―মা একলা রয়েচে, যা সাগর, লাঠিটা হাতে নিয়ে একবার বস্গে। তুমি শুয়ে পড় মা, ভোর না দেখে আমি নড়ব না।
ষোড়শী বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তাই যদি হয় সাগর, একা তুই কি করবি, বাবা?
বাহিরের লোকটি একটু হাসিয়া কহিল, একা কেন, মা, খুড়োকে একটা হাঁক দেব। খুড়ো-ভাইপোয় লাঠি ধরলে জান ত, মা, সব। সেদিনকার লজ্জাতেই মরে আছি, একটিবার যদি হুকুম দিয়ে পাঠাতে মা।
এই দুইটি খুড়ো ও ভাইপো―হরিহর ও সাগর ডাকাতি অপবাদে একবার বছর দুই করিয়া জেল খাটিয়াছিল। জেলের মধ্যে বরঞ্চ ছিল ভাল, কিন্তু অব্যাহতি পাইয়া ইহাদের প্রতি বহুকাল যাবৎ একদিকে জমিদার ও অন্যদিকে পুলিশ কর্মচারীর দৌরাত্মের অবধি ছিল না। কোথাও কিছু একটা ঘটিলে দুইদিকের টানাটানিতে ইহাদের প্রাণান্ত হইত। স্ত্রীপুত্র লইয়া না পাইত ইহারা নির্বিঘ্নে বাস করিতে, না পাইত দেশ ছাড়িয়া কোথাও উঠিয়া যাইতে। এই অযথা পীড়ন ও অহেতুক যন্ত্রণা হইতে ষোড়শী ইহাদের যৎকিঞ্চিত উদ্ধার করিয়াছিল। বীজগাঁর জমিদারি হইতে বাস উঠাইয়া আনিয়া নিজের মধ্যে স্থান দিয়া এবং নানা উপায়ে পুলিশকে প্রসন্ন করিয়া জীবনযাত্রার ব্যাপারটা ইহাদের অনেকখানি সুস্থ করিয়া দিয়াছিল। সেই অবধি দস্যু অপবাদগ্রস্ত এই দুইটি পরম ভক্ত ষোড়শীর সকল সম্পদে বিপদে একান্ত সহায়। শুধু কেবল নীচ জাতীয় ও অস্পৃশ্য বলিয়াই সঙ্কোচে তাহারা দূরে দূরে থাকিত, এবং ষোড়শী নিজেও কখনো কোনদিন তাহাদের কাছে ডাকিয়া ঘনিষ্ঠতা করিবার চেষ্টা করে নাই। অনুগ্রহ কেবল দিয়াই আসিয়াছে, ফিরিয়া কখনো গ্রহণ করে নাই, বোধ করি প্রয়োজনও হয় নাই। আজ এই নির্জন নিশীথে সংশয় ও সঙ্কটের মাঝে তাহাদের আড়ম্বরহীন এই স্নেহ ও নিঃশব্দ সেবার চেষ্টায় ষোড়শীর দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। মুছিয়া ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর,
৭৪