পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যাঁহারা ছিলেন তাঁহাদের কেহই যদিচ অবহেলার বস্তু নহেন, তবুও ইঁহাদের নাম ধাম ও বিবরণ সবিস্তারে বিদিত না হইলেও পাঠকের জীবন দুর্ভর হইয়া উঠিবে না বিবেচনা করিয়া তাহাতে নিরস্ত হইলাম। যাই হোক, ইঁহাদের সমবেত চেষ্টায় অভিযোগের ভূমিকাটা একপ্রকার শেষ হইয়া গেলেও আসল কথাটি উঠি-উঠি করিয়াও থামিয়া যাইতেছিল―ঠিক যেন মুখে আসিয়াও কাহারও বাহির হইতে চাহিতেছিল না।

 জীবানন্দ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সকলের সঙ্গে থাকিয়াও একটুখানি দূরে একটা তাকিয়ার উপর দুই কনুয়ের ভর দিয়া বসিয়া তিনি মন দিয়াই যেন সমস্ত শুনিতেছিলেন। মন প্রফুল্ল। একেবারে স্বাভাবিক না হইলেও সম্পূর্ণ কৃত্রিম বলিয়াও সন্দেহ হয় না। খুব সম্ভব মদের ফেনা তখনও তাঁহার মগজের সমস্ত অলিগলি দখল করিয়া বসে নাই। সুমুখের খোলা দরজা দিয়া বারুইয়ের শুকনা ঢালু ও ভিজা মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছিল, এবং পাশের ঘরটাতেই বোধ করি রান্না হইতেছিল বলিয়া তাহারই রুদ্ধ দ্বারের কোন একটা ফাঁক দিয়া এক-জাতীয় শব্দ ও গন্ধ মাঝে মাঝে এই বাতাসেই ভর দিয়া লোকের কানে ও নাকে আসিয়া পৌঁছিতেছিল, তাহা ব্যক্তিবিশেষের কাছে উপাদেয় ও রুচিকর হইলেও শিরোমণিমহাশয় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিলেন। হঠাৎ তিনি বার-দুই কাশিয়াও উত্তরীয় প্রান্তে নাকের ডগাটা মার্জনা করিয়া, উঠিয়া গিয়া আর এক ধারে বসিতেই জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, শিরোমণিমহাশয়ের কি অর্ধভোজন হয়ে গেল নাকি?

 অনেকেই হাসিয়া উঠিল, শিরোমণির নাকের ডগার মত মুখখানাও রাঙ্গা হইয়া উঠিল। জীবানন্দ তখন হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না; ওটা আপনাদের মা চণ্ডীরই মহাপ্রসাদ। তবে যিনি রাঁধচেন তাঁর গোত্রটি ঠিক জানিনে, হয়ত এক না হতেও পারে।

 শিরোমণি আপনাকে কতকটা সামলাইয়া লইয়া কহিলেন, তা হোক, তা হোক। ব্রাহ্মণ পাচক―দরিদ্র হলেও একটা গোত্র আছে বৈ কি।

 জীবানন্দ হাঃ হাঃ করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া কহিলেন, জানিনে ঠাকুর, ও-সব বালাই ওর কিছু আছে কি না। কিন্তু হাতা, বেড়ির সঙ্গে মিলে সোনার চুড়ির আওয়াজটাও আমার বড় মিঠে লাগে। অব সেই হাতে পরিবেশন করলে―তা নিমন্ত্রণ করলে ত আর―বলিয়া তিনি পুনশ্চ প্রবল হাসির শব্দে ঘর ভরিয়া দিলেন।

 শিরোমণি অধোবদন হইলেন, এবং ভিতরের কদর্য ব্যাপার যদিও সকলেই জানিতেন; তথাপি এই অভাবনীয় প্রকাশ্য নির্লজ্জতায় উপস্থিত কেহই লোকটার মুখের প্রতি সহসা চাহিতে পর্যন্ত পারিল না।

 হাসি থামিলে তিনি কহিলেন, সদালাপ ত হলো। এবং দয়া করে মাঝে মাঝে এলে এমন আরও ঢের হতে পারবে, কিন্তু আপনাদের নালিশটা কি শুনি?

 কিন্তু উত্তরে কাহারও মুখে কথা ফুটিল না, সকলে যেমন নীরবে বসিয়া ছিল তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।

 জীবানন্দ কহিলেন, বলতে কি আপনাদের লজ্জাবোধ হচ্ছে?

৭৯