বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নাহয় চুয়াড়ের মতই দেখতে, তবু ত গৃহস্থ ব্রাহ্মণের মেয়ে―সর্বনাশীই বা হল কি করে, আর বোম্বেটে বদমাশের দলই বা তার জুটল কোথা থেকে?

 এককড়ি কহিল, তা আর আশ্চর্য কি হুজুর! বলিয়া সে ভৈরবীর যে ইতিহাসটা দিল তাহা সংক্ষেপে এইরপ―

 ভৈরবী কাহারও নাম নয়, গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ইহা একটি সাধারণ উপাধি। যেমন বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী এবং ইহার পরে যিনি ছিলেন তাঁহার নাম ছিল মাতঙ্গিনী ভৈরবী। মাতার আদেশে তাঁহার সেবায়েত কখনও পুরুষ হইতে পারে না, মেয়েরাই এ পদ চিরদিন অধিকার করিয়া আসিতেছে।

 আন্দাজ বৎসর পনের-ষোল হইবে হঠাৎ একদিন জানা যায় মাতঙ্গিনী ভৈরবীর স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে। কথাটা অনেক কষ্টে সত্য বলিয়াই প্রমাণিত হয়, তখন বাধ্য হইয়া মাতঙ্গিনীকে পদত্যাগ করিয়া কাশী চলিয়া যাইতে হয়।

 জীবানন্দ এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, বিধবা হলে বুঝি ভৈরবীগিরি খারিজ হয়ে যায়?

 এককড়ি কহিল, হাঁ হুজুর।

 তাই বুঝি তিনি স্বামীটিকে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছিলেন।

 এককড়ি বলিল, সে ছাড়া আর কোন উপায় নেই হুজুর! মায়ের আদেশ বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীর আর ভৈরবী স্পর্শ করবারও জো নেই। তাই দূরদেশে থেকে দুঃখী গরীবের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়া পর্যন্ত দেখতে পায় না। এই-ই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।

 জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, বল কি এককড়ি, এক্কেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুরা ঢেলে দেওয়া―গরম মসলা দিয়া চাট্টি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো―একেবারে কিছুই করতে পায় না?

 এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই; কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখচি। লোকগুলো কি আর খামকা তার পায়ে পায়ে জড়ায়! কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গেই মামলা মোকদ্দমা বাধিয়ে দেয়।

 জীবানন্দ হাসিয়া কহিলেন, মেয়ে মোহন্ত আর কি! তার দোষ নেই, কিন্তু মাতুর পরে ইনি জুটলেন কি করে?

 এককড়ি বলিল, চক্কোত্তিমশাই হচ্ছেন মাতঙ্গিনীর ভাগ্নে। ঢাকা না কোথায় কোন মহাজনের আড়তে খাতা লিখছিলেন, চিঠি পেয়ে চলে এলেন, সঙ্গে একটা বছর দশেকের মেয়ে। কোথা থেকে একটা পাত্রও জুটিয়ে আনলেন―কি জাত, কার ছেলে, কোথায় ঘর―রাতারাতি বিয়ে হল, রাতারাতি চালান দিয়ে দিলেন―তারপর দিব্যি গদিতে বসিয়ে রাজভোগে আছেন। কেবা কথা কয়, কে জিজ্ঞেস করে? গাঁয়েও মানুষ নেই, রাজারও শাসন নেই! বলিয়া সে জমিদারকেই কটাক্ষ করিল। কিন্তু চাহিয়া