বুঝিল, এ বক্রোন্তি নিষ্ফল হইয়াছে। রাজা নিমীলিতচক্ষে এক নিমিষেই যেন তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা নাই―পাছে তাহার কিছুমাত্র অবিবেচনায় এই তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া যায়, এই ভয়ে সে পুত্তলিকার ন্যায় নিশ্চল দাঁড়াইয়া মনে মনে মাতালের পিতৃপুরুষের আদ্যশ্রাদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইবে কিনা ভাবিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ ঠিক সহজ মানুষের মতই পুনরায় কথা কহিলেন, বলিলেন, বছর-পনর পূর্বে, না? আচ্ছা, এই তারাদাস লোকটা কি দেখিতে খুব বেঁটে আর ফরসা?
এককড়ি কহিল, না হুজুর, চক্কোত্তিমশায়ের রঙ ফরসা বটে, কিন্তু ইনি খুব দীর্ঘাঙ্গ।
দীর্ঘাঙ্গ? আচ্ছা, লোকটা যে ঢাকার মহাজনের গদিতে খাতা লিখত এ তুমি জানলে কি করে? এমন ত হতে পারে সে কলকাতায় রাঁধুনি বামুনের কাজ করত?
এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, না হুজুর, সত্যিই তিনি খাতা লিখতেন। তাঁর ছ’ মাসের মাইনে বাকী ছিল, আমিই নালিশ করবার ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখে টাকাটা আদায় করে দিই।
জীবানন্দ কহিলেন, তা হলে সত্যি। আচ্ছা, এই লোকটাই কি বছর-পাঁচেক পূর্বে একটা প্রজা উৎখাতের মামলায় মামার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?
এককড়ি মস্ত একটা মাথায় ঝাঁকানি দিয়া বলিল, হুজুরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। আজ্ঞে, এই সেই তারাদাস।
জীবানন্দ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, হাঁ। সেবার অনেক টাকার ফেরে ফেলে দিয়েছিল। এরা কতখানি জমি ভোগ করে?
এককড়ি মনে মনে হিসাব করিয়া বলিল, পঞ্চাশ-ষাট বিঘের কম নয়।
জীবানন্দ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, কাল তুমি নিজে গিয়ে একে জানিয়ে এসো যে বিঘে পিছু দশ টাকা আমার নজর চাই। আমি আটদিন আছি।
এককড়ি কুণ্ঠিত এবং সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, আজ্ঞে, সে যে নিষ্কর দেবোত্তর হুজুর।
না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই। সেলামী না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।
এককড়ি নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল। সে চক্রবর্তী মহাশয়ের জন্য নয়, তাঁহার কন্যা কাটখোট্টা ষোড়শী ভৈরবীর কথাই স্মরণ করিয়া। জমিদার ত একদিন চলিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাকে যে এই গ্রামেই বাস করিতে হইবে। একবার সে অস্ফুটে বলিতেও গেল, কিন্তু হুজুর―
কিন্তু বক্তব্যটা উহার অধিক অগ্রসর হইতে পাইল না। হুজুর মাঝখানেই থামাইয়া দিয়া কহিলেন, কিন্তু এখন থাক এককড়ি। আমার টাকার দরকার, পাঁচ-ছ শ’ টাকা আমি ছাড়তে পারব না, ওটা তাদের দিতেই হবে! কাল চক্রবর্তীকে খবর দিও যেন কাছারিতে হাজির থাকে। দলিলপত্র কিছু থাকে ত তাও সঙ্গে আনতে
৯