পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রায় সকলেরই ছিল। সেই মাঠসংক্রান্ত কৃষকদের কাছে আজ সে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়াছিল। কথা ছিল তাহারা দেবীর সন্ধ্যা আরতির পরে মন্দির প্রাঙ্গণে জমা হইবে, কিন্তু আরতি শেষ হইয়া গেল, রাত্রি আটটা ছাড়াইয়া নয়টা এবং নয়টা ছাড়াইয়া দশটা বাজিতে চলিল, কিন্তু কাহারও দেখা নাই। প্রণাম করিতে যাহারা নিত্য আসে, প্রসাদ লইয়া একে একে তাহারা প্রস্থান করিল, পূজারী অন্তর্হিত হইল, এবং মন্দিরের ভৃত্য দুয়ার রুদ্ধ করিবার অনুমতি চাহিল। আর অপেক্ষা করিয়া ফল নাই, এবং কি-একটা ঘটিয়াছে তাহাতেও ভুল নাই, কিন্তু ঠিক তাহা জানিতে না পারিয়া সে অত্যন্ত উদ্বেগ অনুভব করিতে লাগিল। এমনি সময়ে ধীরে ধীরে সাগর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে একাকী দেখিয়া ষোড়শী ব্যগ্র হইয়া প্রশ্ন করিল, এত দেরি যে সাগর? কিন্তু আর কেউ ত আসেনি? এরা কি তবে খবর পায়নি বাবা?

 সাগর কহিল, পেয়েচে বৈ কি মা। আমি নিজে গিয়ে সকলের ঘরে ঘরে তোমার ইচ্ছে জানিয়ে এসেছি।

 ষোড়শী শঙ্কিত হইয়া কহিল, তবে?

 সাগর বলিল, আজ বোধ করি কেউ তার সময় করে উঠতে পারলে না। হুজুরের কাছারি বাড়িতে ষোল আনার পঞ্চায়েতি ছিল, তা এইমাত্র সাঙ্গ হলো। পঞ্চু, অনাথ, রামময়, নবকুমার, অক্ষয় মাইতি, মায় আমাদের বড়ো বিপিনখুড়ো পর্যন্ত তার লাজোয়ান ব্যাটাদের নিয়ে। কেউ বাদ যায়নি মা, আমি একটা বাতাপিনেবুগাছের তলায় দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

 ষোড়শী কহিল, ভাল করিসনি সাগর, কেউ দেখে ফেললে―

 সাগর হাসিয়া বলিল, একা যাইনি মা, ইনি সঙ্গে ছিলেন, বলিয়া সে বাঁ হাতের দীর্ঘ বংশদণ্ডখানি সস্নেহে সসম্ভ্রমে দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করিল।

 ষোড়শী কহিল, কিন্তু এইখানে হবার যে কথা ছিল?

 সাগর কহিল, কথাও ছিল, হুজুরের ভোজপুরিগুলোর ইচ্ছেও ছিল কিন্তু গ্রামের কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা ত এদিককার মানুষ―আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে হয়ত চেনেন!

 ষোড়শী ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সভায় কি স্থির হলো?

 সাগর কহিল, তা সব ভাল। এই মঙ্গলেই মেয়েটার অভিষেক শেষ হবে। তবে তোমারও ভাবনা নেই―কাশীবাসের বাবদে প্রার্থনা জানালে শ-খানেক টাকা পেতে পারবে।

 ষোড়শী কহিল, প্রার্থনা জানাতে হবে কার কাছে?

 সাগর বলিল, বোধ হয় হুজুরের কাছেই।

 ষোড়শী জিজ্ঞাসা করিল, আর সকলের? যাদের জমিজমা সব গেল তাদের?

 সাগর বলিল, ভয় নেই মা, চিরকাল ধরে যা হয়ে আসছে তা থেকে তারা বাদ যাবে না। এই যে সেদিন প্রজার কক্ষ থেকে পাঁচ হাজারের নজর দাখিল হলো তার খতের কাগজগুলো ত রায়মশাইয়ের সিন্দুক ছাড়া আর কোথাও জায়গা পায়নি,

৯৫