পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬
দেবদাস

 পিতা কহিলেন, তুমি চিরদিন আমাকে জ্বালাতন করিয়াছ, যতদিন বাঁচিব, ততদিনই জ্বালাতন হইতে হইবে। তোমার মুখে এ-কথায় আশ্চর্য হইবার কিছু নাই।

 দেবদাস নিঃশব্দে অধোবদনে বসিয়া রহিল।

 পিতা কহিলেন, আমি ইহার ভিতর নাই। যা ইচ্ছা হয়, তুমি ও তোমার জননীতে মিলিয়া কর।

 দেবদাসের জননী এ-কথা শুনিয়া কাঁদিয়া কহিলেন,—বাবা, এতও আমার অদৃষ্টে ছিল!

 সেইদিন দেবদাস তোড়জোড় বাঁধিয়া কলিকাতায় চলিয়া গেল।

 পার্ব্বতী এ-কথা শুনিয়া কঠোর মুখে আরও কঠিন হাসিয়া চুপ করিয়া রহিল। গত রাত্রের কথা কেহই জানে না, সেও কাহাকে কহিল না। তবে মনোরমা আসিয়া ধরিয়া বসিল, পারু, শুনলাম দেবদাস চলে গেছে?

 হ্যাঁ—

 তবে, তোর উপায় কি করেচে?

 উপায়ের কথা সে নিজেই জানে না, অপরকে কি বলিবে? আজ কয়দিন হইতে সে নিরন্তর ইহাই ভাবিতেছিল; কিন্তু কোনোক্রমেই স্থির করিতে পারিতেছিল না যে, তাহার আশা কতখানি এবং নিরাশা কতখানি। তবে একটা কথা এই যে, মানুষ এমনি দুঃসময়ের মাঝে আশা-নিরাশার কূলকিনারা যখন দেখিতে পায় না, তখন দুর্বল মন বড় ভয়ে ভয়ে আশার দিকটাই চাপিয়া ধরিয়া থাকে। যেটা হইলে তাহার মঙ্গল, সেইটাই আশা করে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই দিক পানেই নিতান্ত উৎসুক নয়নে চাহিয়া দেখিতে চাহে। পার্ব্বতীর এই অবস্থায় সে কতকটা জোর করিয়া আশা করিতেছিল যে, কাল রাত্রের কথাটা নিশ্চয়ই বিফল হইবে না। বিফল হইলে তাহার দশা কি হইবে, এটা তাহার চিন্তার বাহিরে গিয়া পড়িয়াছিল। তাই সে ভাবিতেছিল, দেবদাদা আবার আসিবে, আবার আমাকে ডাকিয়া বলিবে, পারু, তোমাকে আমি সাধ্য থাকিতে পরের হাতে দিতে পারিব না।

 কিন্তু দিন-দুই পরে পার্ব্বতী এইরূপ পত্র পাইল—

 “পার্ব্বতী, আজ দুইদিন হইতে তোমার কথাই ভাবিয়াছি। পিতামাতার