তা পড়ে। কিন্তু সে কথার আর কাজ কি?
তাহার কণ্ঠস্বর স্থির, কিন্তু অতি রুক্ষ। কিন্তু দেবদাস তাহার মর্ম বুঝিল না; কহিল, আমাকে মাপ কর, পারু।আমি তখন অত বুঝিনি।
চুপ কর। ওসব কথা আমার শুনতেও ভাল লাগে না।
আমি যেমন করিয়া পারি, মা-বাপের মত করিব। শুধু তুমি—
পার্ব্বতী দেবদাসের মুখপানে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, তোমার মা-বাপ আছেন, আমার নেই? তাঁদের মতামতের প্রয়োজন নেই?
দেবদাস লজ্জিত হইয়া কহিল, তা আছে বৈ কি পারু, কিন্তু তাঁদের তো অমত নেই,—তুমি শুধু—
কি করে জানলে তাঁদের অমত নেই? সম্পূর্ণ অমত।
দেবদাস হাসিবার ব্যর্থ প্রয়াস করিয়া কহিল—না গো, তাঁদের একটুকুও অমত নেই—সে আমি বেশ জানি। শুধু তুমি—
পার্ব্বতী কথার মাঝখানেই তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, শুধু আমি! তোমার সঙ্গে? ছিঃ—!
চক্ষের পলকে দেবদাসের দুই চক্ষু আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল। কঠিনকণ্ঠে কহিল, পার্ব্বতী! আমাকে কি ভুলে গেলে?
প্রথমটা পার্ব্বতী থতমত খাইল; কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া লইয়া শান্ত কঠিনস্বরে জবাব দিল, না, ভুলব কেন? ছেলেবেলা থেকে তোমাকে দেখে আসচি, জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত ভয় করে আসচি—তুমি কি তাই আমাকে ভয় দেখাতে এসেচ? কিন্তু আমাকেই কি তুমি চেন না? বলিয়া সে নির্ভীক দুই চক্ষু তুলিয়া দাঁড়াইল।
প্রথমে দেবদাসের বাক্য-নিঃসরণ হইল না; পরে কহিল, চিরকাল ভয় করেই আমাকে এসেচ,—আর কিছু না?
পার্ব্বতী দৃঢ়স্বরে বলিল, না, আর কিছুই না।
সত্যি বলচ?
হ্যাঁ, সত্যিই বলচি। তোমাতে কিছুমাত্র আমার আস্থা নেই। আমি যাঁর কাছে যাচ্ছি, তিনি ধনবান্ বুদ্ধিমান্—শান্ত এবং স্থির। তিনি ধার্মিক। আমার মা-বাপ আমার মঙ্গল কামনা করেন; তাই তাঁরা তোমার মতো একজন অজ্ঞান, চঞ্চলচিত্ত, দুর্দান্ত লোকের হাতে আমাকে কিছুতেই দেবেন না। তুমি পথ ছেড়ে দাও।