পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
৪৫

 পার্ব্বতী মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া বলিল, দেবদা, করলে কি!

 দেবদাস ছিপটা টুকরা টুকরা করিয়া ভাঙ্গিয়া জলে ভাসাইয়া দিতে দিতে স্থিরভাবে উত্তর দিল, বেশী কিছু নয়, সামান্য খানিকটা কেটে গেছে মাত্র।

 পার্ব্বতী আকুল-কণ্ঠে কাঁদিয়া উঠিল—ও গো, দেবদা!

 দেবদাস নিজের পাতলা জামার খানিকটা ছিঁড়িয়া লইয়া, জলে ভিজাইয়া পার্ব্বতীর কপালের উপর বাঁধিতে বাঁধিতে কহিল, ভয় কি পারু! এ আঘাত শীঘ্র সেরে যাবে—শুধু দাগ থাকবে। যদি কেউ কখনো এ কথা জিজ্ঞাসা করে, মিথ্যা কথা বলো; না হয়, সত্য বলে নিজের কলঙ্ক নিজেই প্রকাশ করো।

 ও গো, মা গো!—

 ছিঃ অমন করে না পারু। শেষ-বিদায়ের দিনে শুধু একটুখানি মনে রাখবার মতো চিহ্ন রেখে গেলাম। অমন সোনার মুখ আরশিতে মাঝে মাঝে দেখবে তো? বলিয়া উত্তরের জন্য অপেক্ষামাত্র না করিয়া চলিতে উদ্যত হইল।

 পার্ব্বতী আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, দেবদাদা গো—

 দেবদাস ফিরিয়া আসিল। চোখের কোণে একফোঁটা জল।

 বড় স্নেহজড়িত কণ্ঠে কহিল, কেন রে পারু?

 কাউকে যেন বলো না।

 দেবদাস নিমিষে ঝুঁকিয়া দাঁড়াইয়া পার্ব্বতীর চুলের উপর ওষ্ঠাধর স্পর্শ করিয়া বলিল, ছিঃ—তুই কি আমার পর পারু? তোর মনে নেই, দুষ্টামি করলে ছেলেবেলায় কত তোর কান মলে দিয়েচি।

 দেবদাদা—মাপ কর আমাকে।

 তা তোকে বলতে হবে না ভাই। সত্যিই কি পারু, আমাকে একেবারে ভুলে গেছিস? কবে তোর ওপর রাগ করেছিলাম? কবে মাপ করিনি?

 দেবদাদা—

 পার্বতী, তুমি তো জানো, আমি বেশী কথা বলতে পারিনে; বেশী ভেবেচিন্তে কাজ করতেও পারিনে। যখন যা মনে হয় করি। বলিয়া দেবদাস পার্বতীর মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিল, তুমি ভালই করেছ।