পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
দেবদাস

 মহেন্দ্র লজ্জা পাইয়া কহিল, ঠিক জানিনে মা।

 কিন্তু তাহার কথার ও মুখের ভাবে পার্ব্বতী বুঝিল, যশোদা রাগ করিয়াই আইসে নাই; কহিল, আর আমার ছোটছেলে?

 মহেন্দ্র কহিল, সে শিগগির আসবে। কলকাতায় আছে, পরীক্ষা দিয়েই আসবে।

 ভুবন চৌধুরী নিজেই জমিদারির কাজকর্ম দেখিতেন। তা ছাড়া, স্বহস্তে নিত্য শালগ্রাম-শিলার পূজা করা, ব্রত-নিয়ম-উপবাস, ঠাকুরবাড়ি ও অতিথিশালায় সাধু-সন্ন্যাসীর পরিচর্যা—এইসব কাজে তাঁহার সকাল হইতে রাত্রি দশটা-এগারটা পর্যন্ত কাটিয়া যাইত। নূতন বিবাহ করিয়া কোন প্রকার নূতন আমোদ-আহ্লাদ তাঁহাতে প্রকাশ পাইল না। রাত্রে কোনদিন ভিতরে আসিতেন, কোনদিন বা আসিতে পারিতেন না। আসিলেও অতি সামান্যই কথাবার্তা হইত—শয্যায় শুইয়া পাশবালিশটা টানিয়া লইয়া, চোখ বুজিয়া বড় জোর বলিতেন, তা তুমিই হলে বাড়ির গৃহিণী, সব দেখে-শুনে, বুঝেপড়ে নিজেই নিয়ো—

 পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিত,আচ্ছা।

 ভুবন বলিতেন, আর দেখ, তা এই ছেলেমেয়েরা,—হাঁ তা এরা তোমারই তো সব—

 স্বামীর লজ্জা দেখিয়া পার্ব্বতীর চোখের কোণে হাসি ফুটিয়া বাহির হইত। তিনি আবার একটু হাসিয়া কহিতেন, হাঁ, আর এই দেখ, এই মহেন তোমার বড়ছেলে, সেদিন বি. এ. পাশ করেছে,—এমন ভাল ছেলে, এমন দয়ামায়া—কি জান, একটু যত্ন-আত্মীয়তা—

 পার্ব্বতী হাসি চাপিয়া বলিত, আমি জানি, সে আমার বড়ছেলে—

 তা জানবে বৈ কি! এমন ছেলে কেউ কখনও দেখেনি। আর আমার যশোমতী, মেয়ে তো নয়— প্রতিমা। তা আসবে বৈ কি! আসবে বৈ কি! বুড়ো বাপকে দেখতে আসবে না! তা সে এলে তাকে—

 পার্ব্বতী নিকটে আসিয়া টাকের উপর মৃণালহস্ত রাখিয়া মৃদুস্বরে বলিত, তোমাকে ভাবতে হবে না। যশোকে আনবার জন্য আমি লোক পাঠাব—না হয় মহেন নিজেই যাবে।

 যাবে! যাবে! আহা, অনেকদিন দেখিনি—তুমি লোক পাঠাবে?