পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
৯১

ভৈরব, তোমার দুটো মাঠ এতক্ষণে কি শেষ হ'ল?

 ভৈরব পরিহাসটা বুঝিতে না পারিয়া সরলভাবে বলিল, মা ঠাকরুন, এইবার এসেচি; কিন্তু তোমাদের এই সুখী শরীরে আজ কি আর ফিরে যেতে পারবে?

 চন্দ্রমুখী মনে মনে বলিল, আজ কেন, কাল বোধ করি এ পথ হাঁটতে পারব না।

 প্রকাশ্যে কহিল, ভৈরব, গাড়ি পাওয়া যায় না?

 ভৈরব বলিল, যায় বৈ কি মা, গরুর গাড়ি ঠিক করব?

 গাড়ি ঠিক করিতে আদেশ করিয়া চন্দ্রমুখী জমিদার-বাটী প্রবেশ করিল।

 ভৈরব গাড়ির বন্দোবস্তে অন্যদিকে গেল। অন্দরে উপরের বারান্দায় বড়বৌ (আজকাল জমিদার-গৃহিণী) বসিয়া ছিলেন। একজন দাসী সেইখানে চন্দ্রমুখীকে লইয়া উপস্থিত করিল। উভয়ে উভয়কে নিরীক্ষণ করিল।

 চন্দ্রমুখী নমস্কার করিল। বড়বধূর দেহে অলঙ্কার ধরে না, চোখের কোণ দিয়া অহঙ্কার ফাটিয়া পড়িতেছে। ঠোঁট দুটা ও দাঁতগুলা পান ও মিসিতে প্রায় কালো হইয়া গিয়াছে। একদিকের গাল উঁচু, বোধ হয় দোক্তা আর পানে ভরা আছে। এমন টান করিয়া চুল বাঁধা যে খোঁপাটা মাথার ডগায় উঠিয়াছে। দু'কানে ছোট-বড় বিশ-ত্রিশটা মাকড়ি। নাকের একদিকে নাকচাবি, অপর দিকে মস্ত ফুটা—বোধ হয় শাশুড়ির আমলে তাহাতে নথ পরা হইত।

 চন্দ্রমুখী দেখিল, বড়বৌয়ের বেশ মোটাসোটা মাজা-ঘষা দেহ, বর্ণ বেশ শ্যাম, বেশ ভাসা চোখ, গোল ধরনের মুখ—পরনে কালাপেড়ে শাড়ি, গায়ে একটা দামী জামা—সেইটা দেখিয়া চন্দ্রমুখীর ঘৃণা বোধ হইল। আর বড়বৌ দেখিলেন, চন্দ্রমুখীর বয়স হইলেও শরীরে রূপ ধরে না। দু'জনেই বোধ করি সমবয়সী, কিন্তু বড়বৌ মনে মনে তাহা স্বীকার করিলেন না। এ গ্রামে পার্ব্বতী ভিন্ন অতখানি রূপ তিনি আর কাহারও দেখেন নাই। আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে গা?

 চন্দ্রমুখী কহিল, আমি আপনারই একজন প্রজা; কিছু খাজনা বাকি পড়েচে তাই দিতে এসেচি।

 বড়বৌ মনে মনে খুশি হইয়া বলিলেন, তা এখানে কেন? কাছারি-বাড়ি যাও না।