*8 ধৰ্ম্মতত্ত্ব পরকালের ভয় দেখাইয়া কাহাকেও ধাৰ্ম্মিক করিতে চাহি না। কেন না অনেক লোক পরকাল মানে ন—মুখে মানে ত হৃদয়ের ভিতর মানে না, মনে করে ছেলেদের জুজুর ভয়ের মত মানুষকে শাস্ত করিবার একটা প্রাচীন কথা মাত্র। তাই আজি কালি অনেক লোক পরকালের ভয়ে ভয় পায় না। পরকালের দুঃখের ভয়ের উপর যে ধর্মের ভিত্তি, তাহা এই জন্য সাধারণ লোকের হৃদয়ে সৰ্ব্বত্র বলবান হয় না। “আজিকার দিনে” বলিতেছি, কেন না এক সময়ে এদেশে সে ধৰ্ম্ম বড় বলবানই ছিল বটে। এক সময়ে, ইউরোপেও বড় বলবান ছিল বটে, কিন্তু এখন বিজ্ঞানময়ী উনবিংশ শতাব্দী। সেই রক্তমাংস-পুতিগন্ধ-শালিনী, কামান-গোলা-বারুদ-ব্রীচলোডর-টপাডে প্রভৃতিতে শোভিত৷ রাক্ষসী,—এক হাতে শিল্পীর কল চালাইতেছে, আর এক হাতে বাট ধরিয়া, যাহা প্রাচীন, যাহা পবিত্র, যাহা সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের যত্নের ধন, তাহ বাটাইয়া ফেলিয়া দিতেছে। সেই পোড়ার মুখী, এদেশে আসিয়াও কাল মুখ দেখাইতেছে। তাহার কুহকে পড়িয়া, তোমার মত সহস্ৰ সহস্র শিক্ষিত, অশিক্ষিত, এবং অৰ্দ্ধশিক্ষিত বাঙ্গালী পরকাল আর মানে না। তাই আমি এই ধৰ্ম্মব্যাখ্যায় যত পারি পরকালকে বাদ দিতেছি । তাহার কারণ এই যে, যাহা তোমাদের হৃদয়ক্ষেত্রে নাই, তাহার উপর ভিত্তি সংস্থাপন করিয়া আমি ধৰ্ম্মের মন্দির গড়িতে পারিব না। আর আমার বিবেচনায়, পরকাল বাদ দিলেই ধৰ্ম্ম ভিত্তিশূন্ত হইল না। কেন না, ইহলোকের মুখও কেবল ধৰ্ম্মমূলক, ইহকালের ছঃখও কেবল অধৰ্ম্মমূলক। এখন, ইহকালের ছুঃখকে সকলেই ভয় করে, ইহকালের মুখ সকলেই কামনা করে । এজন্য ইহকালের মুখ ছুঃখের উপরও ধৰ্ম্ম সংস্থাপিত হইতে পারে। এই দুই কারণে, অর্থাৎ ইহকাল সৰ্ব্ববাদিসম্মত, এবং পরকাল সৰ্ব্ববাদিসম্মত নহে বলিয়া, আমি কেবল ইহকালের উপরই ধর্মের ভিত্তি সংস্থাপন করিতেছি। কিন্তু “স্থায়ী সুখ কি ?” যখন এ প্রশ্ন উঠিল, তখন ইহার প্রথম উত্তরে অবশ্ব বলিতে হয় যে, অনন্তকালস্থায়ী যে মুখ, ইহকাল পরকাল উভয় কালব্যাপী যে সুখ, সেই মুখ স্থায়ী সুখ । কিন্তু ইহার দ্বিতীয় উত্তর আছে । শিষ্য। দ্বিতীয় উত্তর পরে শুনিব, এক্ষণে আর একটা কথার মীমাংসা করুন। মনে করুন, বিচারার্থ পরকাল স্বীকার করিলাম। কিন্তু ইহকালে যাহা সুখ, পরকালেও কি তাই মুখ ? ইহকালে যাহা দুঃখ, পরকালেও কি তাই দুঃখ ? আপনি বলিতেছেন, ইহকালপরকালব্যাপী যে সুখ, তাহাই সুখ-এক জাতীয় মুখ কি উভয়কালব্যাপী হইতে পারে ? w
পাতা:ধর্ম্মতত্ত্ব-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৪২
অবয়ব