পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩
নারীর মূল্য

করিয়া সে ভাবিবে, এই পিতা তাহার মিত্র নহে; বাস্তবিক পৃথকৃভাবে একটি একটি করিয়া দেখিলে, এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য। কিন্তু সমগ্রভাবে সমস্ত নারী-জাতির সুখ-দুঃখের, মঙ্গল-অমঙ্গলের ভিতর দিয়। চাহিয়া দেখিলে, পিতা, ভ্রাতা, স্বামীর সমস্ত হীনতা, সমস্ত ফাঁকি একমুহূর্তেই সূর্যের আলোর মত ফুটিয়া উঠে। একটু বুঝাইয়া বলি। কোন একটা বিশেষ নিয়ম যখন দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাহা যে একদিনেই হইয়া যায়, তাহা নহে, ধীরে ধীরে সম্পন্ন হইতে থাকে। যাহারা সম্পন্ন করেন, তাঁহারা পুরুষের অধিকার লইয়া করেন। তখন তাঁহারা পুরুষ—পিতা নন, ভ্রাতা নন, স্বামী নন। যাঁহাদের সম্বন্ধে নিয়ম করা হয়, তাঁহারাও আত্মীয়া নহে, নারী মাত্র। পুরুষ তখন পিতা হইয়া কন্যার দুঃখের কথা ভাবে না; সে তখন পুরুষ হইয়া পুরুষের কল্যাণ চিন্তা করে—নারীর নিকট হইতে কতখানি কিভাবে আদায় করিয়া লইবে, সেই উপায় উদ্ভাবন করিতে থাকে। তার পর মনু আসেন, পরাশর আসেন, মোজেজ আসেন, পল আসেন—শ্লোক বাঁধেন, শাস্ত্র তৈয়ারি করেন—স্বার্থ তখন ধর্ম হইয়া সুদৃঢ়-হস্তে সমাজ শাসন করিবার অধিকার লাভ করে। দেশের পুরুষ-সমাজ ব্যাসদেব, শাস্ত্রকারেরা গণেশ-ঠাকুর মাত্র। সকল দেশের শাস্ত্রই অনেকটা এইভাবেই প্রস্তুত। তার পর শাস্ত্র মানিয়া চলিবার দিন আসে। ধর্মের আসন জুড়িয়া বসিতে তাহার বিলম্ব ঘটে না, এবং সেই ধর্ম-পালনের মুখে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, স্নেহ-মমতা, ভাল-মন্দ বন্যার তৃণের মত ভাসিয়া যায়। দেশের সহমরণেও তাহা দেখিয়াছি, অন্যান্য দেশের অধিকতর নিষ্ঠুর ব্যাপারের মধ্যেও তাহা দেখিয়াছি। ইহুদিরা ঠাকুরের সম্মুখে পুত্র-কন্যা বলি দিতে কুণ্ঠিত হইত না। সন্তান-হত্যার কত নিষ্ঠুর ইতিহাস যে তাহাদের ধর্ম-পুস্তকের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে, তাহার সংখ্যা হয় না। তাদের মলেক দেবতাটি ত শুধু এইজন্যই অমর হইয়া আছেন। মেক্সিকো-বাসী পিতা-মাতারা তেজকাটলিপোকা ঠাকুরের সম্মুখে তাহাদের শ্রেষ্ঠ কন্যাটিকে হত্যা করিয়া পুণ্য অর্জন