পাতা:নৌকাডুবি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিত। অন্নদাবাবুর সংগীতে বিশেষ অনুরক্তি ছিল না, কিন্তু সে কথা তিনি কবুল করিতে পারিতেন না— তবু তিনি আত্মরক্ষার কথঞ্চিৎ চেষ্টা করিতেন। কেহ অক্ষয়কে গান গাহিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলিতেন, “ওই তোমাদের দোষ। বেচারা গাহিতে পারে বলিয়াই কি উহার ’পরে অত্যাচার করিতে হইবে।”

 অক্ষয় বিনয় করিয়া বলিত, “না না অন্নদাবাবু, সেজন্য ভাবিবেন না— অত্যাচারটা কাহার ’পরে হইবে সেইটেই বিচার্য।”

 অনুরোধের তরফ হইতে জবাব আসিত, “তবে পরীক্ষা হউক।”

 সে দিন অপরাহ্ণে খুব ঘনঘোর করিয়া মেঘ করিয়া আসিয়াছিল। প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তনু বৃষ্টির বিরাম নাই। অক্ষয় আবদ্ধ হইয়া পড়িল। হেমনলিনী কহিল, “অক্ষয়বাবু, একটা গান করুন।”

 এই বলিয়া হেমনলিনী হার্মোনিয়মে সুর দিল।

 অক্ষয় বেহালা মিলাইয়া লইয়া হিন্দুস্তানী গান ধরিল—

বায়ু বহীঁ পুরবৈঞা,
নীদ নহীঁ বিন সৈঞা।

 গানের সকল কথার স্পষ্ট অর্থ বুঝা যায় না— কিন্তু একেবারে প্রত্যেক কথায় কথায় বুঝিবার কোনো প্রয়োজন নাই। মনের মধ্যে যখন বিরহমিলনের বেদনা সঞ্চিত হইয়া আছে, তখন একটু আভাসই যথেষ্ট। এটুকু বোঝা গেল যে, বাদল ঝরিতেছে, ময়ূর ডাকিতেছে এবং একজনের জন্য আর-একজনের ব্যাকুলতার অন্ত নাই।

 অক্ষয় সুরের ভাষায় নিজের অব্যক্ত কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছিল— কিন্তু সেভাষা কাজে লাগিতেছিল আর-দুইজনের। দুইজনের হদয় সেই স্বরলহরীকে আশ্র‍য় করিয়া পরস্পরকে আঘাত-অভিঘাত করিতেছিল। জগতে কিছু আর অকিঞ্চিৎকর রহিল না। সব যেন

৩৬