পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

অপূর্ব রামায়ণ

শিব শ্মশানবাসী— আমাদের সর্বোচ্চ মঙ্গলের আদর্শ মৃত্যুনিকেতনে।’

 মুলতান বারোয়াঁ শেষ করিয়া সূর্যাস্তকালের স্বর্ণাভ অন্ধকারের মধ্যে নহবতে পুরবী বাজিতে লাগিল। সমীর বলিল, ‘মানুষ মৃত্যুর পারে যে সকল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নির্বাসিত করিয়া দিয়াছে, এই বাঁশির সুরে সেই সকল চিরাশ্রুসজল হৃদয়ের ধনগুলিকে পুনর্বার মনুষ্যলোকে ফিরাইয়া আনিতেছে। সাহিত্য এবং সংগীত এবং সমস্ত ললিতকলা, মনুষ্যহৃদয়ের সমস্ত নিত্য পদার্থকে মৃত্যুর পরকালপ্রান্ত হইতে ইহজীবনের মাঝখানে আনিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতেছে। বলিতেছে, পৃথিবীকে স্বর্গ, বাস্তবকে সুন্দর এবং এই ক্ষণিক জীবনকেই অমর করিতে হইবে। মৃত্যু যেমন জগতের অসীম রূপ ব্যক্ত করিয়া দিয়াছে, তাহাকে এক অনন্ত বাসরশয্যায় এক পরমরহস্যের সহিত পরিণয়পাশে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেই রুদ্ধদ্বার বাসরগৃহের গোপন বাতায়নপথ হইতে অনন্ত সৌন্দর্যের সৌগন্ধ্য এবং সংগীত আসিয়া আমাদিগকে স্পর্শ করিতেছে, তেমনি সাহিত্যরস এবং কলারস আমাদের জড়ভারগ্রস্ত বিক্ষিপ্ত প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে প্রত্যক্ষের সহিত অপ্রত্যক্ষের, অনিত্যের সহিত নিত্যের, তুচ্ছের সহিত সুন্দরের, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র সুখদুঃখের সহিত বিশ্বব্যাপী বৃহৎ রাগিণীর যোগসাধন করিয়া তুলিতেছে। আমাদের সমস্ত প্রেমকে পৃথিবী হইতে প্রত্যাহরণ করিয়া মৃত্যুর পারে পাঠাইয়া দিব না এই পৃথিবীতেই রাখিব, ইহা লইয়াই তর্ক। আমাদের প্রাচীন বৈরাগ্যধর্ম বলিতেছে, পরকালের মধ্যেই প্রকৃত প্রেমের স্থান; নবীন সাহিত্য এবং ললিতকলা বলিতেছে, ‘ইহলোকেই আমরা তাহার স্থান দেখাইয়া দিতেছি।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘এই প্রসঙ্গে আমি এক অপূর্ব রামায়ণ-কথা বলিয়া সভা ভঙ্গ করিতে ইচ্ছা করি।—

 ‘রাজা রামচন্দ্র— অর্থাৎ মামুষ— প্রেম-নামক সীতাকে নানা রাক্ষসের

১০
১৪৫