পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সৌন্দর্যের সম্বন্ধ

চেষ্টা করে। প্রতিদিন উপার্জন করে, এক দিন খরচ করে; প্রতিদিন দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখে, এক দিন দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেয়; প্রতিদিন গৃহের মধ্যে আমিই গৃহকর্তা, আর এক দিন আমি সকলের সেবায় নিযুক্ত। সেই দিন শুভদিন, আনন্দের দিন, সেই দিনই উৎসব। সেই দিন সম্বৎসরের আদর্শ। সে দিন ফুলের মালা, স্ফটিকের প্রদীপ, শোভন ভূষণ— এবং দূরে একটি বাঁঁশি বাজিয়া বলিতে থাকে, আজিকার এই সুরই যথার্থ সুর, আর সমস্তই বেসুরা। বুঝিতে পারি, আমরা মানুষে মানুষে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মিলিত হইয়া আনন্দ করিতে আসিয়াছিলাম কিন্তু প্রতিদিনের দৈন্যবশতঃ তাহা পারিয়া উঠি না; যে দিন পারি সেই দিনই প্রধান দিন।

 সমীর কহিল, ‘সংসারে দৈন্যের শেষ নাই। সে দিক হইতে দেখিতে গেলে মানবজীবনটা অত্যন্ত শীর্ণ শূন্য শ্রীহীন রূপে চক্ষে পড়ে। মানবাত্মা জিনিসটা যতই উচ্চ হউক না কেন, দুই বেলা দুই মুষ্টি তণ্ডুল সংগ্রহ করিতেই হইবে, এক খণ্ড বস্ত্র না হইলে সে মাটিতে মিশাইয়া যায়। এ দিকে আপনাকে অবিনাশী অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, ও দিকে যে দিন নস্যের ডিবাটা হারাইয়া যায় সে দিন আকাশ বিদীর্ণ করিয়া ফেলে। যেমন করিয়াই হোক, প্রতিদিন তাহাকে আহারবিহার কেনাবেচা দরদাম মারামারি ঠেলাঠেলি করিতেই হয়— সে জন্য সে লজ্জিত। এই কারণে সে এই শুষ্ক ধূলিময় লোকাকীর্ণ হাট-বাজারের ইতরতা ঢাকিবার জন্য সর্বদা প্রয়াস পায়। আহারে বিহারে আদানে প্রদানে আত্মা আপনার সৌন্দর্যবিভা বিস্তার করিবার চেষ্টা করিতে থাকে। সে আপনার আবশ্যকের সহিত আপনার মহত্ত্বের সুন্দর সামঞ্জস্য সাধন করিয়া লইতে চায়।”

 আমি কহিলাম, ‘তাহারই প্রমাণ এই পুণ্যাহের বাঁশি। এক জনের ভূমি, আর এক জন তাহারই মূল্য দিতেছে, এই শুষ্ক চুক্তির মধ্যে লজ্জিত মানবাত্মা একটি ভাবের সৌন্দর্য প্রয়োগ করিতে চাহে। উভয়ের মধ্যে

১৭