পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পল্লিগ্রামে

 সেই সরলতাটুকু চলিয়া গেলে সভ্যতার সমস্ত সৌন্দর্যটুকু চলিয়া যায়। কারণ, স্বাস্থ্য চলিয়া যায়। সরলতাই মনুষ্যপ্রকৃতির স্বাস্থ্য।

 যতটুকু আহার করা যায় ততটুকু পরিপাক হইলে শরীরের স্বাস্থ্যরক্ষা হয়। মসলা দেওয়া ঘৃতপক্ব সুস্বাদু চর্ব চোষ্য লেহ্য পদার্থকে স্বাস্থ্য বলে না।

 সমস্ত জ্ঞান ও বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ পরিপাক করিয়া স্বভাবের সহিত একীভূত করিয়া লওয়ার অবস্থাকেই বলে সরলতা, তাহাই মানসিক স্বাস্থ্য। বিবিধ জ্ঞান ও বিচিত্র মতামতকে মনের স্বাস্থ্য বলে না।

 এথানকার এই নির্বোধ গ্রাম্য লোকেরা যে সকল জ্ঞান ও বিশ্বাস লইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে সে সমস্তই ইহাদের প্রকৃতির সহিত এক হইয়া মিশিয়া গেছে। যেমন নিশ্বাসপ্রশ্বাস রক্তচলাচল আমাদের হাতে নাই, তেমনি এ সমস্ত মতামত রাখা না রাখা তাহাদের হাতে নাই। তাহারা যাহা কিছু জানে, যাহা কিছু বিশ্বাস করে, নিতান্তই সহজে জানে ও সহজে বিশ্বাস করে। সেই জন্য তাহাদের জ্ঞানের সহিত, বিশ্বাসের সহিত, কাজের সহিত, মানুষের সহিত এক হইয়া গিয়াছে।

 একটা উদাহরণ দিই। অতিথি ঘরে আসিলে ইহারা তাহাকে কিছুতেই ফিরায় না। আন্তরিক ভক্তির সহিত অক্ষুণ্ণ মনে তাহার সেবা করে। সে জন্য কোনো ক্ষতিকে ক্ষতি, কোনো ক্লেশকে ক্লেশ বলিয়া তাহাদের মনে উদয় হয় না। আমিও আতিথ্যকে কিয়ৎপরিমাণে ধর্ম বলিয়া জানি, কিন্তু তাহাও জ্ঞানে জানি, বিশ্বাসে জানি না। অতিথি দেখিবামাত্র আমার সমস্ত চিত্তবৃত্তি তৎক্ষণাং তৎপর হইয়া আতিথ্যের দিকে ধাবমান হয় না। মনের মধ্যে নানারূপ তর্ক ও বিচার করিয়া থাকি। এ সম্বন্ধে কোনো বিশ্বাস আমার প্রকৃতির সহিত এক হইয়া যায় নাই।

 কিন্তু স্বভাবের ভিন্ন ভিন্ন অংশের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ঐক্যই মনুষ্যত্বের

৪৪