পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পল্লিগ্রামে

 সেইরূপ যখন দীর্ঘকালের স্থায়িত্ব আশ্রয় করিয়া তর্ক যুক্তি জ্ঞান ক্রমশ সংস্কারে বিশ্বাসে আসিয়া পরিণত হয় তখনি তাহার সৌন্দর্য ফুটিতে থাকে। তখন সে স্থির হইয়া দাঁড়ায় এবং ভিতরে যে সকল জীবনের বীজ থাকে সেইগুলি মানুষের বহু দিনের আনন্দালোকে ও অশ্রুজলবর্ষণে অঙ্কুরিত হইয়া তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে।

 যুরোপে সম্প্রতি যে এক নব সভ্যতার যুগ আবির্ভূত হইয়াছে, এ যুগে ক্রমাগতই নব নব জ্ঞানবিজ্ঞান মতামত স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে; যন্ত্রতন্ত্র উপকরণ -সামগ্রীতেও একেবারে স্থানাভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অবিশ্রাম চাঞ্চল্যে কিছুই পুরাতন হইতে পাইতেছে না।

 কিন্তু দেখিতেছি, এই সমস্ত আয়োজনের মধ্যে মানবহৃদয় কেবলই ক্রন্দন করিতেছে, য়ুরোপের সাহিত্য হইতে সহজ-আনন্দ সরল-শান্তির গান একেবারে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছে। হয় প্রমোদের মাদকতা, নয় নৈরাশ্যের বিলাপ, নয় বিদ্রোহের অট্টহাস্য।

 তাহার কারণ, মানবহৃদয় যত ক্ষণ এই বিপুল সভ্যতাস্তূপের মধ্যে একটি সুন্দর ঐক্য স্থাপন করিতে না পারিবে তত ক্ষণ কখনোই ইহার মধ্যে আরামে ঘরকন্না পাতিয়া প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিবে না। তত ক্ষণ সে কেবল অস্থির অশাস্ত হইয়া বেড়াইবে। আর সমস্তই জড়ো হইয়াছে, কেবল এখনো স্থায়ী সৌন্দর্য, এখনো নবসভ্যতার রাজলক্ষ্মী আসিয়া দাঁড়ান নাই। জ্ঞান বিশ্বাস ও কার্য পরস্পরকে কেবলই পীড়ন করিতেছে— ঐক্যলাভের জন্য নহে, জয়লাভের জন্য পরস্পরের মধ্যে সংগ্রাম বাঁঁধিয়া গিয়াছে।

 কেবল যে প্রাচীন স্মৃতির মধ্যে সৌন্দর্য তাহা নহে, নবীন আশার মধ্যেও সৌন্দর্য, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যুরোপের নূতন সভ্যতার মধ্যে এখনো আশার সঞ্চার হয় নাই। বৃদ্ধ যুরোপ অনেক বার অনেক আশায়

৪৯