পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

মন

করিয়া কেমন একটি খেলা খেলিয়া লইল! এমনি করিয়া জনহীন মধ্যাহ্নে সমস্ত মাঠময় নাচিয়া বেড়ায়। না আছে তাহার কোনো উদ্দেশ্য না আছে তাহার কেহ দর্শক— না আছে তাহার মত, না আছে তাহার তত্ত্ব, না আছে সমাজ এবং ইতিহাস সম্বন্ধে অতি সমীচীন উপদেশ— পৃথিবীতে যাহা কিছু সর্বাপেক্ষা অনাবশ্যক, সেই সমস্ত বিস্মৃত পরিত্যক্ত পদার্থগুলির মধ্যে একটি উত্তপ্ত ফুৎকার দিয়া তাহাদিগকে মুহূর্তকালের জন্য জীবিত জাগ্রত সুন্দর করিয়া তোলে।

 অমনি যদি অত্যন্ত সহজে এক নিশ্বাসে কতকগুলা যাহা-তাহা খাড়া করিয়া, সুন্দর করিয়া ঘুরাইয়া উড়াইয়া, লাটিম খেলাইয়া চলিয়া যাইতে পারিতাম! অমনি অবলীলাক্রমে স্বজন করিতাম, অমনি ফুঁ দিয়া ভাঙিয়া ফেলিতাম। চিন্তা নাই, চেষ্টা নাই, লক্ষ্য নাই; শুধু একটা নৃত্যের আনন্দ, শুধু একটা সৌন্দর্যের আবেগ, শুধু একটা জীবনের ঘূর্ণা! অবারিত প্রান্তর, অনাবৃত আকাশ, পরিব্যাপ্ত সূর্যালোক— তাহারই মাঝখানে মুঠা মুঠা ধূলি লইয়া ইন্দ্রজাল নির্মাণ করা, সে কেবল খেপা হৃদয়ের উদার উল্লাসে।

 এ হইলে তো বুঝা যায়। কিন্তু বসিয়া বসিয়া পাথরের উপর পাথর চাপাইয়া গলদ্‌ঘর্ম হইয়া কতকগুলা নিশ্চল মতামত উচ্চ করিয়া তোলা! তাহার মধ্যে না আছে গতি, না আছে প্রীতি, না আছে প্রাণ। কেবল একটা কঠিন কীর্তি। তাহাকে কেহ বা হাঁ করিয়া দেখে, কেহ বা পা দিয়া ঠেলে— যোগ্যতা যেম্‌নি থাক্।

 কিন্তু ইচ্ছা করিলেও এ কাজে ক্ষান্ত হইতে পারি কই। সভ্যতার খাতিরে মানুষ মন-নামক আপনার এক অংশকে অপরিমিত প্রশ্রয় দিয়া অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছে; এখন তুমি যদি তাহাকে ছাড়িতে চাও, সে তোমাকে ছাড়ে না।

৬৫