পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

মন

দিগন্তের পরপারে কী আছে। ঐ আকাশের তারাগুলি যে গাছের শাখায় ফুটিয়া আছে, সে গাছ কেমন করিয়া নাগাল পাইব। আমি কোথা হইতে আসিলাম, কোথায় যাইব, এ কথা যত ক্ষণ না স্থির হইবে তত ক্ষণ আমি পাতা ঝরাইয়া, ডাল শুকাইয়া, কাঠ হইয়া, দাঁড়াইয়া ধ্যান করিতে থাকিব। আমি আছি অথবা আমি নাই, অথবা আমি আছিও বটে নাইও বটে, এ প্রশ্নের যত ক্ষণ মীমাংসা না হয় তত ক্ষণ আমার জীবনে কোনো সুখ নাই। দীর্ঘ বর্ষার পর যে দিন প্রাতঃকালে প্রথম সূর্য ওঠে সে দিন আমার মজ্জার মধ্যে যে একটি পুলক-সঞ্চার হয় সেটা আমি ঠিক কেমন করিয়া প্রকাশ করিব, এবং শীতান্তে ফাল্গুনের মাঝামাঝি যে দিন হঠাৎ সায়ংকালে একটা দক্ষিণের বাতাস উঠে সে দিন ইচ্ছা করে— কী ইচ্ছা করে কে আমাকে বুঝাইয়া দিবে।’

 এই সমস্ত কাণ্ড! গেল বেচারার ফুল ফোটানো, রসশস্যপূর্ণ আতাফল পাকানো। যাহা আছে তাহা অপেক্ষা বেশি হইবার চেষ্টা করিয়া, যে রকম আছে আর এক রকম হইবার ইচ্ছা করিয়া, না হয় এ দিক, না হয় ও দিক। অবশেষে এক দিন হঠাৎ অন্তর্বেদনায় গুঁড়ি হইতে অগ্রশাখা পর্যন্ত বিদীর্ণ হইয়া বাহির হয় একটা সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ, একটা সমালোচনা, আরণ্য সমাজ সম্বন্ধে একটা অসাময়িক তত্ত্বোপদেশ। তাহার মধ্যে না থাকে সেই পল্লবমর্মর, না থাকে সেই ছায়া, না থাকে সর্বাঙ্গব্যাপ্ত সরস সম্পূর্ণতা।

 যদি কোনো প্রবল শয়তান সরীসৃপের মতো লুকাইয়া মাটির নীচে প্রবেশ করিয়া, শতলক্ষ আঁকাবাঁকা শিকড়ের ভিতর দিয়া পৃথিবীর সমস্ত তরুলতা তৃণগুল্মের মধ্যে মনঃসঞ্চার করিয়া দেয়, তাহা হইলে পৃথিবীতে কোথায় জুড়াইবার স্থান থাকে! ভাগ্যে বাগানে আসিয়া পাখির গানের মধ্যে কোনো অর্থ পাওয়া যায় না এবং অক্ষরহীন সবুজ পত্রের পরিবর্তে

৬৭