পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থাকলেই তা সত্য হয়ে উঠে না। এ ফাঁকির কথা। যারা কোনদিন দেশের কাজ করেনি এ তাদের কথা, দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থ যাদের ঢের বড় এ তাদের কথা। এর মধ্যে এতটুকু সত্য নেই। আপনি নিজে যখন কাজে লাগবেন, তখনই এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করবেন যে যাকে আপনি নারীর বাইরে এসে ভিড় করা বল্‌চেন সে যদি কখনও ঘটে, তখনই দেশের কাজ হবে, নইলে পুরুষের ভিড়ে শুক্‌নো বালির মত সমস্ত ঝরে পড়বে, কোনদিন জমাট বাঁধবে না।

 অপূর্ব্ব মনে মনে লজ্জা পাইয়া কহিল, কিন্তু এতে কি দুর্নীতি বাড়বে না? চরিত্র কলুষিত হবার ভয় থাকবে না?

 সুমিত্রা বলিলেন, ভয় কি ভিতরেই কম থাকে নাকি? অপূর্ব্ববাবু, ওটা বাইরে আসার দোষ নয়, দোষ বিধাতার, যিনি নর-নারী সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে অনুরাগের আকর্ষণ দিয়েচেন, তাঁর। অপূর্ব্ববাবু, মনের মধ্যে একটুখানি বিনয় রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে একবার চেয়ে দেখুন দিকি?

 এই মন্তব্য শুনিয়া অপূর্ব্ব খুশী হইতে পারিল না, বরঞ্চ একটুখানি তীব্রতার সঙ্গেই বলিয়া উঠিল, অন্য দেশের কথা অন্য দেশ ভাবুক, আমি আমাদের নিজেদের কল্যাণ চিন্তা করতে পারলেই যথেষ্ট মনে করব। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন, কিন্তু এখানে একটা বস্তু আমি লক্ষ্য না করে পারিনি যে, বিবাহিত জীবনের প্রতি আপনাদের আস্থা নেই, এমন কি নারীত্বের যা চরম উৎকর্ষ, সেই সতীত্ব ও পাতিব্রত্য ধর্ম্মকেও আপনারা অবহেলার চক্ষে দেখেন। এর থেকে আসবে দেশের কল্যাণ?

 সুমিত্রা ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া সকৌতুক স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, অপূর্ব্ব বাবু আপনি একটু রাগ করে বলচেন, নইলে ঠিক ও ভাব ত আমি প্রকাশ করিনি। তবে, আগাগোড়াই যে আপনি ভুল বুঝেচেন তাও নয়। যে সমাজে কেবলমাত্র পুত্রার্থেই ভার্য্যা গ্রহণের বিধি আছে, নারী হয়ে তাকে ত আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারিনে। আপনি সতীত্বের চরম উৎকর্ষের বড়াই করেছিলেন, কিন্তু, এই যে-দেশে বিবাহের ব্যবস্থা, সে-দেশে ও-বস্তু বড় হয় না, ছোটই হয়। সতীত্ব ত শুধু দেহেই পর্য্যবসিত নয় অপূর্ব্ববাবু, মনেরও ত দরকার? কায়মনে ভালবাসতে না পারলে ত ওর উচ্চস্তরে পৌঁছান যায় না? আপনি কি সত্যই মনে করেন মন্ত্র পড়ে বিয়ে দিলেই যে-কোন বাঙালী মেয়ে যে-কোন বাঙালী পুরুষকে ভালবাসতে পারে? এ কি পুকুরের জল যে যে-কোন পাত্রে ঢেলে মুখ বন্ধ করে দিলেই কাজ চলে যাবে?

 অপূর্ব্ব হঠাৎ কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কহিল, কিন্তু চিরকাল চলেও ত যাচ্চে?

 সুমিত্রা তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া মাথা নাড়িয়া কহিলেন, তা যাচ্চে। প্রাণাধিক স্বামী বলে পাঠ লিখতেও তার বাধে না, কর্ত্তব্যবোধে শ্রদ্ধাভক্তি করতেও

৯৭