পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিন্তু অপূর্ব্ব সহসা আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিল, জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এঁরা আজকাল কোথায় থাকেন এবং কি করেন?

 তাহার উৎসুক্য ও ব্যগ্রতায় ডাক্তার শুধু মুচকিয়া হাসিলেন।

 অপূর্ব্ব কহিল, হাসলেন যে?

 ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, আপনাদের সেই কাকাবাবুটি উপস্থিত থাকলে কিন্তু বুঝতেন। আপনার বিশ্বাস আমি একজন এ্যানার্কিস্টদের পাণ্ডা। তার মুখ থেকে কি এর জবাব আশা করতে আছে অপূর্ব্ববাবু?

 নিজের বুদ্ধিহীনতার এই সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে অপূর্ব্ব অপ্রতিভ হইল, মনে মনে একটু রাগও করিল, কহিল, আশা করা সম্পূর্ণই অনুচিত হতো আজ যদি না আমাকে দলভুক্ত করে নিতেন। মেম্বারদের এটুকু জানবার আছে, এ বোধ করি আপনি অস্বীকার করেন না। এ তো ছেলেখেলা নয়, ভীষণ দায়িত্ব আছে যে!

 আছেই ত। বলিয়া ডাক্তারবাবু হাসিলেন। এই সুমিষ্ট হাসি ও নিরাতঙ্ক সহজ উক্তি ঠিক ব্যাঙ্গোক্তির মতই অপূর্ব্বর কানে রাজিল। বিদ্রোহী দলের বাঁধানো খাতায় যাহার নাম লেখা হইল তাহার প্রশ্নের এই উত্তর? এর বেশি জানিবার তাহার প্রয়োজন নাই। মনে মনে ভীত ও ক্রুদ্ধ হইয়া এই লোকটিকে আজ সে ভুল বুঝিল, কিন্তু এই ভুল সংশোধন করিয়া পরবর্ত্তীকালে বহুবারই তাহাকে দেখিতে হইয়াছে, কোন অবস্থায় কোন কারণেই ইহার মুখের হাসি উদ্বেগে এবং গলার স্বপ্ন উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠে না।

 নিঃশব্দ গাম্ভীর্য্যে ডাক্তারের এই সামান্য সংক্ষিপ্ত জবাবটাকে সে প্রতিঘাত করিতে চাহিয়া নিরুত্তরে পথ চলিতে লাগিল, কিন্তু অধিকক্ষণ থাকিতে পারিল না, ওই ছোট্ট কথাটুকুর নিদারুণ তীক্ষ্ণতা তীরের ফলাটুকুর মতন যেন তাহার বুকে বিঁধিতে লাগিল, তিক্তকণ্ঠে কহিল, দলের খাতায় তাড়াতাড়ি নাম লিখে নিলেই ত হয় না, তার ফলাফল বুঝিয়ে ও দিতে হয়।

 কিন্তু সে কি তাঁরা দেন নি?

 অপূর্ব্ব কহিল, কিছুই না। পথের দাবী, না পথের দাবী। দাবীর বহর যে এত তা কে জানতো? আর আপনিও ত ছিলেন, নাম লেখাবার পূর্ব্বে আপনারও ত জানা উচিত ছিল আমার যথার্থ মতামত কি।

 ডাক্তার একটু লজ্জিত হইয়া বলিলেন, মেয়েরা একটা ব্যাপার করেছেন, তাঁরাই জানেন কাকে মেম্বার করবেন এবং কাকে করবেন না। আমি হঠাৎ জুটে গেছি মাত্র। বাস্তবিকই আমি এদের সভার বিশেষ কিছু জানিনে অপূর্ব্ববাবু!

 অপূর্ব্ব বুঝিল ইহাও পরিহাস। উৎকণ্ঠায় ও আশঙ্কায় সমস্ত জিনিসটাই তাহার

১০৬