পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না, সে না থাকার মধ্যেই; তথাপি সে উপলক্ষটুকুকেই হেতু নির্দ্দেশ করিতে পাইয়া অপূর্ব্ব স্বস্তি বোধ করিল।

 ভারতী ঘরে ঢুকিয়া তাহার প্রতি একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া যে সকল হাতের কাজ তখন পর্য্যন্ত অসম্পূর্ণ ছিল করিতে লাগিল, তাহার কপট নিদ্রা ভাঙাইবার চেষ্টা করিল না, কিন্তু এই পুরাতন বাটীর সুপ্রাচীন দরজা জানালা বন্ধ করার কাজে যে পরিমাণে শব্দ-সাড়া উত্থিত হইতে লাগিল তাহা সত্যকার নিদ্রার পক্ষে যে একান্ত বিঘ্নকর তাহা নিজেই উপলব্ধি করিয়া অপূর্ব্ব উঠিয়া বসিল। চোখ রগড়াইয়া হাই তুলিয়া কহিল, উঃ—এই রাত্রে আবার ফিরে আসতে হোলো।

 ভারতী টানাটানি করিয়া একটা জানলা রুদ্ধ করিতেছিল, বলিল, যাবার সময় এ কথা বলে গেলেন না কেন? সরকার মহাশয়কে দিয়ে আপনার খাবারটা একেবারে আনিয়ে রেখে দিতাম।

 কথা শুনিয়া অপূর্ব্বর ঘুম-ভাঙা গলার শব্দ একেবারে তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, কহিল, তার মানে? ফিরে আসবার কথা আমি জানতাম না কি?

 ভারতী লোহার ছিটকিনিটা চাপিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া সহজকণ্ঠে জবাব দিল, আমারই ভুল হয়েছে। খাবার কথাটা তখনি তাকে বলে পাঠানো উচিত ছিল। এত রাত্তিরে আর হাঙ্গামা পোয়াতে হোতো না। এতক্ষণ কোথায় দুজনে বসে কাটালেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, তাঁকেই জিজ্ঞেসা করবেন। ক্রোশ-তিনেক পথ হাঁটার নাম বসে কাটানো কি না, আমি ঠিক জানিনে।

 ভারতীর জানালা বন্ধ করার কাজ তখনও সম্পূর্ণ হয় নাই, ছিটের পর্দ্দাটা টানিয়া দিতেছিল, সেই কাজেই নিযুক্ত থাকিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, ইস্, গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন বলুন! হাঁটাই সার হ’ল! এই বলিয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিয়া কহিল, সন্ধ্যা-আহ্নিক করার বালাই এখনো আছে না গেছে? থাকে ত কাপড় দিচ্ছি, ওগুলো সব ছেড়ে ফেলুন। এই বলিয়া সে অঞ্চল সুদ্ধ চাবির গোছা হাতে লইয়া একটা আলমারি খুলিতে খুলিতে কহিল, তেওয়ারী বেচারা ভেবে সারা হয়ে যাবে। আজ ত দেখচি অফিস থেকে একেবারে বাসায় যাবারও সময় পাননি।

 অপূর্ব্ব রাগ চাপিয়া বলিল, অবশ্য আপনি এমন অনেক জিনিস দেখতে পান যা আমি পাইনে তা স্বীকার করচি, কিন্তু কাপড় বার করবার দরকার নেই। সন্ধ্যা-আহ্নিকের বালাই আমার যায়নি, এ-জন্মে যাবেও তা মনে হয় না, কিন্তু আপনার দেওয়া কাপড়েও তার সুবিধে হবে না। থাক্‌, কষ্ট করবেন না।

১১২