পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জানি দুঃখ করবার আমার কিছু নেই। এই বলিয়া সে আলোটা তুলিয়া ধরিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, আমি আলো দেখাচ্চি, যান আপনি নীচে থেকে মুখ ধুয়ে আসুন। জলের ঘটীটা সুমুখেই আছে,—যেন ভুলে আসবেন না।

 অপূর্ব্ব নীচে চলিয়া গেল। খানিক পরে মুখ-হাত ধুইয়া উপরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, তাহার ভুক্তাবশেষ সরাইয়া উচ্ছিষ্ট স্থানটা ভারতী ইতিমধ্যেই পরিষ্কার করিয়াছে; দুই-একটা চৌকি প্রভৃতি স্থানান্তরিত করিয়া তাহার খাবার জায়গা করা হইয়াছিল, সেগুলা যথাস্থানে আনা হইয়াছে এবং যে ইজি-চেয়ারটায় সে ইতিপূর্ব্বে বসিয়াছিল তাহারই একপাশে ছোট টিপায়ার উপরে রেকাবিতে করিয়া সুপারি-এলাচ প্রভৃতি মশলা রাখা হইয়াছে। ভারতীর হাত হইতে তোয়ালে লইয়া মুখ-হাত মুছিয়া মশলা মুখে দিয়া সে আরাম কেদারায় বসিয়া পড়িল এবং হেলান দিয়া তৃপ্তির গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, আঃ—এতক্ষণে দেহে প্রাণ এল। কি ভয়ঙ্কর ক্ষিদেই না পেয়েছিল!

 তাহার চোখের সুমুখ হইতে আলোটা সরাইয়া ভারতী একপাশে রাখিতেছিল, সেই আলোতে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অপূর্ব্ব হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া বলিল, আপনার খুব সর্দ্দি হয়েছে দেখচি যে!

 ভারতী বাতিটা তাড়াতাড়ি রাখিয়া দিয়া বলিল, কই, না।

 না কেন! গলা ভারি, চোখ ফুলো ফুলো, দিব্যি ঠাণ্ডা লেগেছে! এতক্ষণ খেয়ালই করিনি।

 ভারতী জবাব দিল না। অপূর্ব্ব কহিল, ঠাণ্ডা লাগার অপরাধ কি! এই রাত্তিরে যা ছুটোছুটি করতে হল!

 ভারতী ইহারও উত্তর দিল না। অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বলিল, ফিরে এসে নিরর্থক আপনাকে কষ্ট দিলাম। কিন্তু কে জানত বলুন, ডাক্তারবাবু ডেকে এনে শেষে আপনাকে বোঝা টানতে দিয়ে নিজে সরে পড়বেন। ভুগতে হ’ল আপনাকে।

 ভারতী জানালার কাছে পিছন ফিরিয়া কি একটা করিতেছিল, কহিল, তা তো হোলই। কিন্তু ভগবান বোঝা টানতে দিলে আর নালিশ করতে যাবো কার বিরুদ্ধে বলুন?

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, তার মানে?

 ভারতী তেমনি কাজ করিতে করিতেই বলিল, মানে কি ছাই আমিই জানি? কিন্তু দেখচি ত, বর্ম্মায় আপনি পা দেওয়া পর্য্যন্ত বোঝা টেনে বেড়াচ্চি শুধু আমিই। বাবার সঙ্গে করলেন ঝগড়া, দণ্ড দিলাম আমি। ঘর পাহারা দিতে রেখে গেলেন। তেওয়ারীকে তার সেবা করে মলুম আমি। ডেকে আনিলেন ডাক্তারবাবু, হাঙ্গামা

১১৮