পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পোহাতে হচ্ছে আমাকে। ভয় হয়, সারা জীবনটা না শেষে আমাকেই আপনার বোঝা বয়ে কাটাতে হয়। কিন্তু রাত ত আর নেই, শোবেন কোথায় বলুন ত?

 অপূর্ব্ব বিস্মিত হইয়া বলিল, বাঃ, আমি তার জানি কি?

 ভারতী কহিল, হোটেলে ডাক্তারবাবুর ঘরে আপনার বিছানা করতে বলে এসেছি, ব্যবস্থা বোধহয় হয়েছে!

 কে নিয়ে যাবে? আমি ত চিনিনে।

 আমিই নিয়ে যাচ্ছি, চলুন ডাকাডাকি করে তাদের তুলিগে।

 চলুন, বলিয়া অপূর্ব্ব তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। একটু সঙ্কোচের সহিত কহিল, কিন্তু আপনার বালিশ এবং বিছানার চাদরটা আমি নিয়ে যাবো। অন্ততঃ এ দুটো আমার চাই-ই, পরের বিছানায় আমি মরে গেলেও শুতে পারবো না। এই বলিয়া সে শয্যা হইতে তুলিতে যাইতেছিল, ভারতী বাধা দিল। এতক্ষণে তাহার মলিন গম্ভীর মুখ স্নিগ্ধ কোমল হাস্যে ভরিয়া উঠিল। কিন্তু সে তাহা গোপন করিতে মুখ ফিরাইয়া আস্তে আস্তে বলিল, এও তো পরের বিছানা অপূর্ব্ববাবু, ঘৃণা বোধ না হওয়াই ত ভারি আশ্চর্য্য। কিন্তু তাই যদি হয়, আপনার হোটেলে শুতে যাবার প্রয়োজন কি, আপনি এই খাটেতেই শোন। এ কথাটা সে ইচ্ছা করিয়াই বলিল না যে, মাত্র ঘণ্টা-কয়েক পূর্ব্বেই তাহার দেওয়া অশুচি বস্ত্রে ভগবানের উপাসনা করিতেও ঘৃণা বোধ হইয়াছিল।

 অপূর্ধ্ব অধিকতর সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল, বলিল, কিন্তু আপনি কোথায় শোবেন? আপনার ত কষ্ট হবে!

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, একটুও না। অঙ্গুলি দিয়া দেখাইয়া কহিল, ওই ছোট ঘরটায় যা হোক একটা কিছু পেতে নিয়ে আমি স্বচ্ছন্দে শুতে পারবো। শুধু কাঠের মেঝের উপরে হাতে মাথা রেখে তেওয়ারীর পাশে কত রাত্রি কাটাতে হয়েছে সে তো আপনি দেখতে পাননি।

 অপূর্ব্ব একমাস পূর্ব্বের কথা স্মরণ করিয়া বলিল, একটা রাত্রি আমিও দেখতে পেয়েছি, একেবারে পাইনি তা নয়।

 ভারতী হাসিমুখে বলিল, সে কথা আপনার মনে আছে? বেশ তেমনি ধারাই না হয় আর একটা রাত্রি দেখতে পাবেন।

 অপূর্ব্ব ক্ষণকাল অধোমুখে নীরবে থাকিয়া বলিল, তেওয়ারীর তখন ভয়ানক অসুখ,—কিন্তু এখন লোকে কি মনে করবে?

 ভারতী জবাব ছিল, কিছুই মনে করবে না। কারণ, পরের কথা নিয়ে নিরর্থক মনে করবার মত ছোট মন এখানে কারও নেই।

১১৯