পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কখনও পায় নাই—তাহার এমনি মনে হইতে লাগিল!

 সকালবেলার তাহার ঘুম ভাঙিল ভারতীর ডাকে। চোখ মেলিয়া দেখিল সম্মুখে তাহার পায়ের কাছে দাঁড়াইয়া এই মেয়েটি, পূবের জানালা দিয়া প্রভাতসূর্য্যের রাঙা আলো তাহার সদ্যস্নাত ভিজা চুলের উপরে, তাহার পরণের শাদা গরদের রাঙা পাড়টুকুর উপরে, তাহার সুন্দর মুখখানির স্নিগ্ধ শ্যাম রঙের উপরে পড়িয়া একেবারে যেন অপরূপ হইয়া অপূর্ব্বর চোখে ঠেকিল।

 ভারতী কহিল, উঠুন, আবার আফিসে যেতে হবে ত!

 তা’তো হবেই বলিয়া অপূর্ব্ব শয্যা ত্যাগ করিল। আপনার ত দেখচি স্নান পর্য্যন্ত সারা হয়ে গেছে।

 ভারতী কহিল, আপনাকেও সমস্ত তাড়াতাড়ি সেরে নিতে হবে। কাল অতিথি-সৎকারের যথেষ্ট ত্রুটি হয়েছে, আজ আমাদের প্রেসিডেণ্টের আদেশে আপনাকে ভাল করে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়া হবে না।

 অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, কালকের সেই মেয়েটি বেঁচেচে?

 তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে—বাঁচবে বলেই আশা।

 মেয়েটিকে অপূর্ব্ব চোখেও দেখে নাই, তথাপি তাহারই সুখবরে মন যেন তাহাৱ পরম লাভ বলিয়া গণ্য করিল। আজ কাহারও কোন অকল্যাণ সে যেন সহিতেই পারিবে না তাহার এমনি জ্ঞান হইল।

 সে স্নান-আহ্নিক সারিয়া কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া যখন উপরে আসিল তখন বেলা প্রায় নয়টা। ইতিমধ্যে ঠাঁই করিয়া সরকার মশায় খাবার রাখিয়া গেছেন, অপূর্ব্ব আসনে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কই, আপনাদের প্রেসিডেণ্টের সঙ্গে ত দেখা হ’ল না। তাঁর অতিথি সৎকারের বুঝি এই রীতি?

 ভারতী বলিল, আপনার যাবার আগে দেখা হবে বই কি। তাঁর আপনার সঙ্গে বোধ করি একটু কাজও আছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, আর ডাক্তারবাবু? যিনি আমাকে ডেকে এনেচেন? এখনো বোধহয় তিনি বিছানাতেই পড়ে? এই বলিয়া সে হাসিল।

 ভারতী এ হাসিতে যোগ দিল না, কহিল, বিছানায় পড়বার তাঁর সময়ই হয়নি। এই ত হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন। শোওয়া না-শোওয়া কোনটার কোন মূল্যই তাঁর কাছে নেই।

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, এতে তাঁর অসুখ করে না?

 ভারতী বলিল, কখনো দেখিনে ত। সুখ অসুখ দুই-ই বোধহয় তাঁর কাছে হার মেনে পালিয়েছে। মানুষের সঙ্গেই তাঁর তুলনা হয় না।

১২১