পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্বর কাল রাত্রের অনেক কথাই স্মরণ হইল, মৃদুকণ্ঠে কহিল, আপনারা সকলেই বোধ হয় তাকে অতিশয় ভক্তি করেন?

 ভক্তি করি? ভক্তি ত অনেকেই অনেককে করে। বলিতে বলিতেই তাহার কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ গাঢ় হইয়া উঠিল, কহিল, তিনি চলে গেলে মনে হয় পথের ধুলোয় পড়ে থাকি, তিনি বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। মনে হয়, তবুও আশা মেটে না অপূর্ব্ববাবু। বলিয়াই সে মুখ ফিরাইয়া চট্‌ করিয়া চোখের কোণ দুটা মুছিয়া ফেলিল।

 অপূর্ব্ব আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না, নতমুখে নিঃশষে আহার করিতে লাগিল। তাহার এই কথাটাই বার বার মনে হইতে লাগিল, সুমিত্রা ও ভারতীর মত এতবড় শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী নারী-হৃদয়ে যে-মানুষ এতখানি উচ্চে সিংহাসন গড়িয়াছে, জানি না ভগবান তাহাকে কোন ধাতু দিয়া তৈরি করিয়া পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন! কোন্ অসাধারণ কার্য্য তাহাকে দিয়া তিনি সম্পন্ন করাইয়া লইবেন।

 দূরে দরজার কাছে ভারতী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, অপূর্ব্ব নিজেও বিশেষ কোন কথা কহিল না, অতঃপর খাওয়াটা তাহার এক প্রকার নিঃশব্দেই সমাধা হইল। অপ্রীতিকর কোন কিছুই ঘটে নাই, তথাপি যে প্রভাতটা আজ তাহার বড় মিষ্ট হইয়া শুরু হইয়াছিল, অকারণে কোথা হইতে যেন তাহার উপরে একটা ছায়া আসিয়া পড়িল।

 আফিসের কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া সে কহিল, চলুন, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

 চলুন, তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

 সরকার মহাশয়ের জরা-জীর্ণ হোটেল-বাড়ির একটা অত্যন্ত ভিতরের দিকের ঘরে ডাক্তারবাবুর বাসা। আলো নাই, বাতাস নাই, আশেপাশে নোংরা জল জমিয়া একটি দুর্গন্ধ উঠিতেছে, অতিশয় পুরাতন তক্তার মেঝে, পা দিতে ভয় হয় পাছে সমস্ত ভাঙিয়া পড়ে, এমনি একটা কদর্য্য বিশ্রী ঘরে ভারতী যখন তাহাকে পথ দেখাইয়া আনিল, তখন বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না! ঘরে ঢুকিয়া অপূর্ব্ব ক্ষণকাল ত ভাল দেখিতেই পাইল না।

 ডাক্তারবাবু অভ্যর্থনা করিয়া কহিলেন, আসুন অপূর্ব্ববাবু।

 উঃ—কি ভীষণ ঘরই আপনি আবিষ্কার করেচেন ডাক্তারবাবু?


 কিন্তু কি রকম সস্তা বলুন ত! মাসে দশ আনা ভাড়া।

 অপূর্ব্ব কহিল, বেশি, বেশি, ঢের বেশি। দশ পয়সা হওয়া উচিত।

 ডাক্তার কহিলেন, আমরা দুঃখী লোকেরা সব কি রকম থাকি আপনাদের চোখে দেখা উচিত। অনেকের কাছে এই আবার রাজপ্রাসাদ!

১২২