পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছুটিতে লাগিল। কোনমতে জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিল, ধরুন, তারা যদি কেউ চিনতেই পারে? যদি ধরে ফেলে?

 ডাক্তার কহিলেন, ধরে ফেললে বোধ হয় ফাঁসিই দেবে। কিন্তু দশটার ট্রেনের আর ত সময় নেই অপূর্ব্ববাবু, আমি চললাম। এই বলিয়া তিনি স্ট্র্যাপে বাঁধা মস্ত বোঝাটা অবলীলাক্রমে পিঠে ফেলিয়া চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলিয়া লইলেন।

 ভারতী একটি কথাও কহে নাই, একটি কথাও কহিল না, শুধু পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। সুমিত্রাও প্রণাম করিল, কিন্তু সে পায়ের কাছে নয়, একেবারে পায়ের উপরে। হঠাৎ মনে হইল সে বুঝি আর উঠিবে না, এমনি করিয়া পড়িয়াই থাকিবে—বোধ হয় মিনিট খানেক হইবে—যখন সে নীরবে উঠিয়া দাঁড়াইল তখন স্বল্পালোকিত সেই ক্ষুদ্র ঘরের মধ্যে তাহার আনত মুখের চেহারা দেখিতে পাওয়া গেল না!

 ডাক্তার ঘরের বাহিরে আসিয়া অপূর্ব্বর হাতখানি গত রাত্রির মতো মুঠার মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিলেন, চললাম অপূর্ব্ববাবু—আমি সব্যসাচী।

 অপূর্ব্বর মুখের ভিতরটা শুকাইয়া মরুভূমি হইয়া গিয়াছিল, তাহার গলা দিয়া স্বর ফুটিল না, কিন্তু সে চক্ষের পলকে হাঁটু পাতিয়া তাঁহার পায়ের কাছে মেয়েদের মতই ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল। ডাক্তার মাথায় তাহার হাত দিলেন, আর একটা হাত ভারতীর মাথায় দিয়া অস্ফুটে কি বলিলেন শোনা গেল না, তাহার পরে একটু দ্রুত পদেই বাহির হইয়া গেলেন।

 অপূর্ব্ব উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল ভারতীর পাশে সে একাকী দাঁড়াইয়া আছে, পিছনে সেই ভাঙা ঘরের রুদ্ধ দ্বারের অন্তরালে কর্তব্য-কঠিন অশেষ বুদ্ধিশালিনী পথের দাবীর ভয়লেশহীনা তেজস্বিনী সভানেত্রী কি যে করিতে লাগিলেন তাহার কিছুই জানা গেল না।


১৪

 ভারতী ও অপূর্ব্ব দুজনেই পিছনের দরজার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল, কিন্তু কেহই কোন কথা কহিল না। অপূর্ব্ব কিছুই না বুঝিয়াও এটুকু বুঝিল যে, এমন করিয়া যে লোক নিজেকে স্বেচ্ছায় বন্দী করিয়া রাখিল তাহার সম্বন্ধে কৌতূহলী হইতে নাই। উভয়ে নীরবে হোটেলের বাহিরে আসিতে ভারতী কহিল, চলুন অপূর্ব্ববাবু আমরা ঘরে যাই—

 কিন্তু আমার যে আবার অফিসের বেলা—

 রবিবারেও অফিস?

১২৪