পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 রবিবার, তাই ত বটে! অপূর্ব্ব খুশী হইয়া বলিল, একথা সকালে মনে হলে নাওয়া-খাওয়ার জন্য আর ব্যস্ত হতে হত না। আপনার এত জিনিস মনে থাকে, কিন্তু ওটুকু ভুলে গিয়েছিলেন।

 ভারতী একটু হাসিয়া বলিল, তা’ হবে, কিন্তু কাল রাত্রে আপনার না-খাওয়ার কথাটি তুলিনি।

 অপূর্ব্ব হঠাৎ থমকিয়া কহিল, আমার দেরি করবার জো নেই, তেওয়ারী বেচারা হয়ত ভেবে সারা হয়ে যাচ্চে।

 ভারতী বলিল, যাচ্ছে না তার কারণ, আপনি জাগবার পূর্ব্বেই সে খবর পেরেচে আপনি কুশলে আছেন।

 সে জানে আমি আপনার কাছে আছি?

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানে। ভোরবেলাতেই আমি লোক পাঠিয়ে দিয়েচি।

 এই সংবাদ শুনিয়া অপূর্ব্ব শুধু নিশ্চিন্ত নয়, তাহার মনের উপর হইতে একটা সত্যকার বোঝা নামিয়া গেল। কালরাত্রে ফিরিবার পথে, ফিরিয়া আসিয়া, খাওয়া শোয়া, সকল কাজে সকল কথার মধ্যে এই ভাবনাই বহুবার তাহাকে ধাক্কা মারিয়া গেছে, কি জানি কাল সকালে তেওয়ারী ব্যাটা তাহার কথা বিশ্বাস করিবে কি না। এই বর্ম্মাদেশের কতপ্রকার জনশ্রুতিই না প্রচলিত আছে,—হয়ত বাড়িতে মায়ের কাছে কি একটা লিখিয়া দিবে, না হয়ত ফিরিয়া গিরা গল্প করিবে,—পাকা কালীর মত, কালী গেলেও যাহার দাগ মুছিবে না—এই তুচ্ছ বস্তুটাই ছোট্ট কাঁটার মত তাহার পায়ে প্রদি পদক্ষেপেই খচ্ খচ্ করিতেছিল। এতক্ষণ পরে সে যেন নির্ভয়ে পা ফেলিয়া বাঁচিল। তেওয়ারী আর যাহাই করুক, ভারতীর মুখের কথা সে মরিয়া গেলেও অবিশ্বাস করিবে না। যে ছাড়-পত্র ভারতী লিখিয়া দিয়াছে তাহার চেয়ে নিষ্কলঙ্কতার বড় দলিল তেওয়ারীর কাছে যে আর নাই, অপূর্ব্ব তাহা ভাল করিয়াই জানিত। পুলকিতচিত্তে কহিল, আপনার সকল দিকে চোখ আছে। বাড়িতে বৌদিদেরও দেখেচি, অন্য সব মেয়েদেরও দেখেচি, আমার মাকেও দেখেচি, কিন্তু এমন সবদিকে দৃষ্টি আমি কাউকে দেখিনি। বাস্তবিক বলচি, আপনি যে বাড়ির গৃহিণী হবেন সে বাড়ির লোকেরা চোখ বুজে দিন কাটিয়ে দেবে, কখনো কাউকে দুঃখ পেতে হবে না।

 ভারতীর মুখের উপর দিয়া যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। অপূর্ব্ব ইহার কিছুই দেখিল না, সে পিছনে আসিতেছিল, পিছন হইতেই পুনরায় কহিল, এই বিদেশে আপনি না থাকলে আমার কি হোত বলুন ত! সমস্ত চুরি যেত, তেওয়ারী

১২৫