পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দুজনে প্রায় মাইলখানেক পথ হাঁটিয়া একটা প্রকাণ্ড কারখানার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বন্ধ ফটকের কাটা দরজার ফাঁক দিয়া গলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। ডানদিকে সারি সারি করোগেট লোহার গুদাম ও তাহারই ও-ধারে কারিগর ও মজুরদিগের বাস করিবার ভাঙা কাঠ ও ভাঙা টিনের লম্বা লাইনবদী বস্তি। সুমুখ দিয়া সারি সারি কয়েকটা জলের কল এবং পিছন দিকে সারি সারি টিনের পায়খানা। গোড়াতে হয়তো দরজা ছিল, এখন থলে ও চট-ছেঁড়া ঝুলিতেছে। ইহাই ভারতবর্ষীয় কুলী-লাইন। পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী, বর্ম্মী, বাঙালী, উড়ে, হিন্দু, মুসলমান, স্ত্রী ও পুরুষে প্রায় হাজার খানেক জীব এই ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়া দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া চলিয়াছে।

 ভারতী কহিল, আজ কাজের দিন নয়, নইলে এই জলের কলেই দু’একটা রক্তারক্তি কাণ্ড দেখতে পেতেন।

 অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ছুটির দিনের ভিড় দেখেই তা অনুভব করতে পারচি।

 এই জনতার সম্মুখেই একজন মাদ্রাজী স্ত্রীলোক পর্দ্দা ঠেলিয়া পায়খানায় ঢুকিতেছিল, পর্দ্দার অবস্থা দেখিয়া অপূর্ব্ব লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিয়া বলিল, পথের দাবী করতে হয় ত আর কোথাও শীঘ্র চলুন, এখানে আমি দাঁড়াতে পারব না।

 ভারতী নিজেও তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল, কিন্তু প্রত্যুত্তরে শুধু একটুখানি হাসিল। অর্থাৎ মানুষের ধাপ হইতে নামাইয়া যাহাদের পশু করিয়া তোলা হইয়াছে তাহাদের আবার এসকল বালাই কেন?

 কয়েকখানা ঘর পরে উভয়ে আসিয়া একজন বাঙালী মিস্ত্রির ঘরে প্রবেশ করিল। লোকটার বয়স হইয়াছে, কারখানায় পিতল ঢালাইয়ের কাজ করে, মদ খাইয়া কাঠের মেঝের উপর পড়িয়া অত্যন্ত মুখ ধারাপ করিয়া কাহাকে গালি পাড়িতেছিল, ভারতী ডাকিয়া কহিল, মানিক, কার ওপরে রাগ করচ? সুশীলা কই? সে আজ দু’দিন পড়তে যায় না কেন?

 মানিক কোন মতে হাতে পায়ে ভর দিয়া উঠিয়া বসিল, চোখ চাহিয়া চিনিতে পারিয়া বলিল, দিদিমণি। এসো, ব’সো। সুশী কি ক’রে তোমার ইস্কুলে যাবে বল? রাঁধা-বাড়া বাসন মাজা মায় ছেলেটাকে সামলানো পর্য্যন্ত—বুক ফেটে যাচ্চে দিদিমণি, বোর্দো শালাকে আমি খুন না করি ত আমি কৈবর্ত্ত থেকে খারিজ। বড় সাহেবকে এমনি দরখাস্ত দেব যে শালার চাকরি খেয়ে দেব।

 ভারতী সহাস্যে কহিল, তা দিয়ো। আর বল ত না হয়, সুমিত্রাদিদিকে দিয়ে আমিই তোমার দরখাস্ত লিখে দেব। কিন্তু কাল আমাদের ফয়ার মাঠে মিটিং, তা মনে আছে ত?

১৩১