পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 আর ডাক্তারবাবু?

 ভারতী হাসিয়া বলিল, ডাক্তারবাবুর সম্বন্ধে আপনার ভারী কৌতূহল। একথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না কেন যে, পৃথিবীতে যা’ কিছু জানা যায় তিনি জানেন, যা’ কিছু পারা যায় তিনি পারেন। কে তাঁর সব্যসাচী নাম রেখেছিল আমরা কেউ জানিনে, কিন্তু তাঁর অসাধ্য, তাঁর অজ্ঞাত সংসারে কিচ্ছু নেই। এই বলিয়া সে নিজের মনে চলিতেই লাগিল, কিন্তু তাহারই পিছনে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া অপূর্ব্বর মুখ দিয়া গভীর নিশ্বাস পড়িল। অকস্মাৎ এই কথাটা তাহারা বুকের মধ্যে উদ্বেলিত হইয়া উঠিল যে, এই হতভাগ্য পরাধীন দেশে এতবড় একটা প্রাণের কোন মূল্য নাই, যে-কোন লোকের হাতে যে-কোন মুহূর্ত্তে তাহা কুকুরশিয়ালের মত বিনষ্ট হইতে পারে। সমস্ত জগৎ-বিধানে এতবড় নিষ্ঠুর অবিচার আর কি আছে! ভগবান মঙ্গলময় এই যদি সত্য, এ তবে কাহার ও কোন পাপের দণ্ড?

 উভয়ে একটা ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। ভারতী ডাকিল, পাঁচকড়ি, কেমন আছ আজ?

 অন্ধকার কোণ হইতে সাড়া আসিল, আজ একটু ভাল। এই বলিয়া একজন বুড়া গোছের লোক ডান হাত উঁচু করিয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার আগাগোড়া কি কতকগুলি প্রলেপ দেওয়া, কহিল, মা, মেয়েটা রক্ত আমাশায় বোধ হয় বাঁচবে না, ছেলেটার আবার কাল থেকে বেহুঁস জ্বর, এমন একটা পয়সা নেই যে এক ফোঁটা ওষুধ কিনে দি, কি এক বাটি সাগু-বার্লি রেঁধে খাওয়াই। তাহার দুই চোখ ছল ছল করিয়া আসিল।

 অপূর্ব্বর মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গেল, পয়সা নেই কেন?

 এই অপরিচিত বাবুটিকে লোকটা কয়েক মুহূর্ত্ত নীরবে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, পুলির শেকল পড়ে ডানহাতটাই জখম হয়ে গেছে, মাসখানেক ধরে কাজে বার হতে পারিনি, পয়সা থাকবে কি করে বাবুমশায়?

 অপূর্ব্ব প্রশ্ন করিল, কারখানার ম্যানেজার এর ব্যবস্থা করেন না?

 পাঁচকড়ি কপালে একবার বাম হাতটা স্পর্শ করিয়া কহিল, হায়! হায়! দিন-মজুরদের আবার ব্যবস্থা! এতেই বলচে কাজ করতে না পারো ত ঘর ছেড়ে দাও, আবার যখন ভাল হবে তখন এস—কাজ দেব। এ অবস্থায় কোথায় যাই বলুন ত মশায়? ছোট সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে বড় জোর হপ্তাহখানেক থাকতে পাব। বিশ বচ্ছর কাজ করচি মশায়, এরা এখনি নেমকহারাম!

 কথা শুনিয়া অপূর্ব্ব রাগে জ্বলিতে লাগিল। তাহার, এমনি ইচ্ছা করিতে লাগিল,

১৩৪