পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ম্যানেজার লোকটাকে পায় ও কান ধরিয়া টানিয়া আনিয়া দেখায় সুদিনে যাহারা লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করিয়া দিয়াছে, আজ দুর্দ্দিনে তাহারা কি দুঃখই ভোগ করিতেছে! অপূর্ব্বদের বাটীর কাছে গরুর গাড়ির আড্ডা, তাহার মনে পড়িল, এক জোড়া গরু সমস্ত জীবন ধরিয়া বোঝা টানিয়া অবশেষে বৃদ্ধ ও অক্ষম হইয়া পড়িলে লোকটা তাদের কসাইখানার বিক্রী করিয়া দিয়াছিল। এই হৃদয়হীনতা নিবারণ করিবার উপায় নাই, লোকে করে না, কেহ করিতে চাহিলে সবাই তাকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দেয়। সেই পথ দিয়া যখনই সে গিয়াছে, তখনই এই কথা মনে করিয়া তাদের চোখে জল আসিয়াছে। গরুর জন্য নয়, কিন্তু অর্থের পিপাসায় এই বর্ব্বর নিষ্ঠুরতার মানুষে আমাকে আপনি কত ছোটই না প্রতিদিন করিয়া আনিতেছে। সহসা ভারতীর কথাটা স্মরণ করিয়া সে মনে মনে কহিল, ঠিক কথাই ত! কে কোথায় করিতেছে—আমি ত করি না, অথবা, এমনিই ত হয়, এই ত চিরদিন হইয়া আসিতেছে—এই বলিয়াই ত এত বড় ত্রুটির জবাবদিহি হয় না। গরু-ঘোড়া শুধু উপলক্ষ্য। এই হাত-ভাঙা পাঁচকড়িটাও তাই। আপনাকে যে বাঁচাইতে পারে না তাহার হত্যায়, যে দুর্ব্বল তাহার পীড়নে, যে নিরুপায় তাহার লজ্জাহীন বঞ্চনায় এই যে মানুষে আপনার হৃদয়-বৃত্তির জীবন হরণ করিতেছে, সকলের এই যে আত্মহত্যার অহোরাত্রব্যাপী উৎসব চলিতেছে, ইহার বাতি নিভিবে কবে? এই সর্ব্বনাশা উন্মত্ততার পরিসমাপ্তি ঘটিবে কোন পথ দিয়া। মরণের আগে কি আর তাহার চেতনা ফিরিবে না!

 ঘরের একধারে মলিন শতচ্ছিন্ন শয্যায় ছেলে-মেয়ে দুটি মৃতকল্পের ন্যায় পড়িয়াছিল, ভারতী কাছে গিয়া তাহাদের গায়ে হাত দিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল। অপূর্ব্ব ভয়ে সেখানে যাইতে পারিল না, কিন্তু দরিদ্র, পীড়িত শিশু দুটির নিঃশব্দ বেদনা তাহার বুকের মধ্যে যেন মুগুরের ঘা মারিতে লাগিল। সে সেইখানে দাঁড়াইয়া উচ্ছ্বসিত আবেগে আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল, লোকে বলে, এই ত দুনিয়া। এমনি ভাবেই ত সংসারের সকল কাজ চিরদিন হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু এই কি যুক্তি! পৃথিবী কি শুধু অতীতেরই জন্য। মানুষ কি কেবল তাহার পুরাতন সংস্কার লইয়া অচল হইয়া থাকিবে! নতুন কিছু কি সে কল্পনা করিবে না! উন্নতি করা কি তাহার শেষ হইয়া গেছে! যাহা বিগত, যাহা মৃত, কেবল তাহারই ইচ্ছা, তাহারই বিধান মানুষের সকল ভবিষ্যৎ, সকল জীবন, সকল বড় হওয়ার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া চিরকাল ধরিয়া প্রভুত্ব করিতে থাকিবে!

 চলুন।

 অপূর্ব্ব চমকিয়া দেখিল, ভারতী। পাঁচকড়ি নীরবে ম্লানমুখে দাঁড়াইয়াছিল,

১৩৫