পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্ত্রীলোকের হাতে মদের গেলাস ছিল, সে বোধ হয় তখনও পাকা হইয়া উঠে নাই, হয়ত অল্পদিন পূর্ব্বেই গৃহত্যাগ করিয়াছে, সে বাঁ হাতে সজোরে নিজেকে নাক টিপিয়া ধরিয়া গেলাসটা মুখে ঢালিয়া দিয়। তক্তার ফাঁক দিয়া অপর্য্যাপ্ত থুথু ফেলিতে লাগিল। একজন পুরুষ তাড়াতাড়ি তাহার মুখে খানিকটা তরকারি গুঁজিয়া ছিল। বাঙালী মেয়েমানুকে চোখের সুমুখে মদ খাইতে দেখিয়া অপূর্ব্ব যেন এক্কেবারে শীর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু সে আড়চোখে চাহিয়া দেখিল, এতবড় ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্যেও ভারতীর মুখের উপরে বিকৃতির চিহ্ন মাত্র নাই। এসব তাহার সহিয়া গেছে। কিন্তু ক্ষণেক পরে গৃহস্বামীর ফরমাসে টুনি যখন গান ধরিল, এই যমুনা সেই যমুনা—এবং পাশের লোকটা হারমোনিয়াম টানিয়া লইয়া খামোকা একটা চাবি টিপিয়া ধরিয়া প্রাণপণে বোলো করিতে শুরু করিল, তখন এত ভার ভারতীর বোধ হয় সহিল না। সে ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, মিস্ত্রীমশায়, কাল আমাদের মিটিং। এ কথা বোধ হয় ভোলনি? যাওয়া কিন্তু চাই-ই।

 চাই বই কি দিমিণি! এই বলিয়া কালাচাঁদ একপাত্র মদ গলায় ঢালিয়া দিল।

 ভারতী কহিল, ছেলেবেলায় পড়েচ ত খড় পাকিয়ে দড়ি করলে হাতী বাঁধা যায়? এক না হলে তোমরা কখনোও কিছু করতে পারবে না। কেবল তোমাদের ভালর জন্যই সুমিত্রাদিদি কি পরিশ্রম করেছেন বল ত!

 এ কথায় সকালে একবাক্যে সায় দিল। ভারতী বলিতে লাগিল, তোমরা ছাড়া কি এতবড় কারখানা একদিন চলে? তোমরাই ত এর সত্যিকারের মালিক, এ তো সোজা কথা কালাচাঁদ, এ তোমরা না বুঝতে চাইলে হবে কেন?

 সবাই বলিল, এ ঠিক কথা। তাহারা না চালাইলে সমস্ত অন্ধকার।

 ভারতী কহিল, অথচ, তোমাদের কত কষ্ট একবার ভেবে দেখ দিকি। যখন তখন বিনা দোষে সাহেবরা তোমাদের লাথি জুতো মেরে বার করে দেয়। এই পাশের ঘরেই দেখ, কাজ করতে গিয়ে পাঁচকড়ির হাত ভেঙেচে বলে আজ সে খেতে পায় না, তার ছেলে-মেয়ে দুটো ওষুধ-পথ্যির অভাবে মারা যাচ্চে। ঘর থেকে পর্য্যন্ত বড়সাহেব তাকে দূর করে দিতে চায়। এই যে ক্রোর ক্রোর টাকা এরা লাভ করচে সে কাদের দৌলতে? আর তোমরা পাও কতটুকু? এই যে সেদিন শ্যামলালকে ছোটসাহের ঠেলে ফেলে দিলে, আজও সে হাসপাতালে, এ তোমরা সহ্য করবে কেন? একবার সবাই এক হয়ে দাঁড়িয়ে জোর করে বলত, এ নির্য্যাতন আমরা আর সইব না, কেমন তোমাদের গায়ে হাত দিতে সাহস করে দেখি! কেবল একটি বার তোমাদের সত্যিকার জোরটুকু তোমরা চেয়ে দেখতে শেখো—আর আমরা তোমাদের কাছে কিছুই চাইনে কালাচাঁদ।

১৩৮