পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অপূর্ব্ব আর প্রতিবাদ করিল না, চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু এই যুক্তিকে সে মনে মনে সমর্থন করিল না। একদিন স্বদেশের কাছে এই লোকটি বহু দুঃখ পাইয়াছে, আজও তাহার অন্তরের তেজ একেবারে নিবিয়া যায় নাই, সামান্য প্রসঙ্গেই সহসা তাহা স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, এই কথা মনে করিয়া অপূর্ব্ব শ্রদ্ধায় বিগলিত হইল, কিন্তু তাহার অধিক আর কিছু সে সত্য-সত্যই প্রত্যাশা করিল না। আহ্বান করিলেই সে যে স্ত্রী-পুত্রের মায়া কাটাইয়া, তাহাদের প্রতিপালনের পথ কণ্টকাকীর্ণ করিয়া পথের দাবীর সভ্য হইতে ছুটিয়া যাইবে ইহা সে বিশ্বাসও করিল না, ইচ্ছাও করিল না। স্বদেশ-সেবার অধিকারের স্পর্দ্ধা এই কয়দিনেই তাহার এতখানি উঁচু হইয়া গিয়াছিল। সহসা এ প্রসঙ্গ সে বন্ধ করিয়া আগামী সভার হেতু ও উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা করিতে গিয়া বন্ধুর কাছে কিন্তু এখন সরলকণ্ঠেই ব্যক্ত করিল যে, সেই একটি দিন ভিন্ন জীবনে কখনো সে বক্তৃতা করে নাই; সুমিত্রার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারিবে না, কিন্তু একের কথা বহুজনকে শুনাইবার মত ভাষা বা অভিজ্ঞতা কোনটাই তাহার আয়ত্ত নয়।

 তলওয়ারকর জিজ্ঞাসা করিল, কি করবেন তাহ’লে?

 অপূর্ব্ব বলিল, বক্তৃতা করার মত কেবল একটি দিনই জীবনে আমার কারখানা দেখবার সুযোগ ঘটেছে। তাদের কুলি-মজুরেরা যে অধিকাংশই পশুর জীবন-যাপন করে এ আমি অসংশয়ে অনুভব করে এসেছি, কিন্তু কেন, কিসের জন্যে তার ত কিছুই জানিনে।

 রামদাস হাসিয়া কহিল, তবু আপনাকে বলতে হবে? নাই-ই বললেন।

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা গেল, এতবড় মর্য্যাদ ত্যাগ করা তাহার পক্ষে কঠিন।

 রামদাস নিজে তখন বলিল, আমি কিন্তু এদের কথা কিছু কিছু জানি।

 কেমন করে জানলেন?

 বহুদিন এদের মধ্যে ছিলাম অপূর্ব্ববাবু। আমার চাকরির সার্টিফিকেটগুলো একবার চেয়ে দেখলেই দেখতে পাবেন দেশে আমি কলকারখানা, কুলি-মজুর নিয়েই কাল কাটিয়েছি। যদি হুকুম করেন ত অনেক দুঃখের কাহিনীই আপনাকে শোনাতে পারি। বাস্তবিক, এদের না দেখলে যে দেশের সত্যকার ব্যথার জায়গাটাই বাদ পড়ে যার বাবুজি।

 অপূর্ব্ব কহিল, সুমিত্রাও ঠিক এই কথাই বলেন।

 রামদাস কহিল, না বলে ত উপায় নেই। এবং জানেন বলেই ত পথের দাবীর কর্ত্রী তিনি। বাবুজি, আত্মত্যাগের উৎসই ঐখানে। দেশের সেবার বনেদ ওর ’পরে,

১৪৫