পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রিপোর্ট করিব বলিয়া ভয় দেখাইল, কিন্তু কিছুই হইল না। সে নির্ব্বিকার চিত্তে নিজের খাতাপত্র দুরস্ত করিতে লাগিল, জবাবও দিল না। আর সময় নষ্ট করা নিষ্ফল বুঝিয়া অপূর্ব্ব ক্ষুধার তৃষ্ণায় ও ক্রোধে জ্বলিতে জ্বলিতে বড় টেলিগ্রাফ অফিসে আসিয়া অনেক ভিড় ঠেলিয়া অনেক বিলম্বে নিজের নির্ব্বিঘ্নে পৌঁছান সংবাদ যখন মাকে পাঠাইতে পারিল, তখন বেলা আর বড় নাই!

 দুঃখের সাথী দরোয়ানজী সনিয়ে নিবেদন করিল, সাহেব, হামকো ভি বহুত দূর যানা হ্যায়।

 অপূর্ব্ব একান্ত পরিশ্রান্ত ও অন্যমনস্ক হইয়াছিল, ছুটি দিতে আপত্তি করিল না। তাহার ভরসা ছিল নম্বর দেওয়া রাস্তাগুলা সোজা ও সমান্তরাল থাকায় গম্ভব্যস্থান খুঁজিয়া লওয়া কঠিন হইবে না। দরোয়ান অন্যত্র চলিয়া গেল, সেও হাঁটিতে হাঁটিতে এবং গলির হিসাব করিতে করিতে অবশেষে বাটীর দম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।

 সিঁড়িতে পা দিয়াই দেখিল দ্বিতলে তাহার দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তেওয়ারী ঠাকুর মস্ত একটা লাঠি ঠুকিতেছে এবং অনর্গল বকিতেছে, এবং প্রতিপক্ষ একব্যক্তি খালি গায়ে পেণ্টুলুন পরিয়া তেতালার কোঠায় নিজের খোলা দরজায় সুমুখে দাঁড়াইয়া হিন্দী ও ইংরেজীতে ইহার জবাব দিতেছে এবং একটা ঘোড়ার চাবুক লইয়া মাঝে মাঝে সাঁই সাঁই শব্দ করিতেছে। তেওয়ারী তাহাকে নীচে ডাকিতেছে, সে তাহাকে উপরে আহ্বান করিতেছে,—এবং এই সৌজন্যের আদান-প্রদান যে ভাষায় চলিতেছে তাহা না বলাই ভাল।

 সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়া অপূর্ব্ব তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল। এইটুকু সময়ের মধ্যে ব্যাপারটা যে কি ঘটিল, কি উপায়ে তেওয়ারীজী এইটুকু অবসরেই প্রতিবেশী সাহেবের সহিত এতখানি ঘনিষ্ঠতা করিয়া লইল, সে তাহার কিছুই ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু অকস্মাৎ বোধ হয় দুই পক্ষের দৃষ্টিই তাহার উপর নিপতিত হইল। তেওয়ারী মনিবকে দেখিয়া আর একবার সজোরে লাঠি ঠুকিয়া কি একটা মধুর সম্ভাষণ করিল, সাহেব তাহার জবাব দিয়া প্রচণ্ডশব্দে চাবুক আস্ফালন করিলেন, কিন্তু পুনশ্চ যুদ্ধ ঘোষণার পূর্ব্বেই অপূর্ব্ব দ্রুতপদে উঠিয়া গিয়া লাঠিসুদ্ধ তেওয়ারীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, তুই কি খেপে গেছিস? এই বলিয়া তাহাকে প্রতিবাদের অবসর না দিয়াই জোর করিয়া ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। ভিতরে গিয়া সে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কাঁদ কাঁদ হইয়া কহিল, এই দেখুন, হারামজাদা সাহেব কি কাণ্ড করেচে।

 বাস্তবিক, কাণ্ড দেখিয়া অপূর্ব্বর শান্তি এবং ঘুম, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা একই কালে অন্তর্হিত হইয়া গেল। সুসিদ্ধ খেচরান্নের হাঁড়ি হইতে তখন পর্য্যন্ত উত্তাপ ও

১১